পাট নিয়ে বিপাকে মেহেরপুরের কৃষকরা

 

মুক্ত জলাশয়ের অভাব : পাটের কাঙ্ক্ষিত দাম পচ্ছেন না কৃষক

মেহেরপুর অফিস: পর্যাপ্ত পানির অভাবে পাট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মেহেরপুরের কৃষকেরা। উন্মুক্ত জলাশয় না থাকায় মাছ চাষের পুকুর, ডোবা, অথবা নিচু কোনো জায়গা ভাড়া নিয়ে তাতে শ্যালোইঞ্জিনের সাহায্যে পানি জমিয়ে পাট পঁচাতে কৃষককে বাড়তি অর্থ গুণতে হচ্ছে। পাশাপাশি জাগ দেয়ার সময় পাটের আটি ডুবাতে কাদা-মাটি ব্যবহার করায় পাটের রঙ হচ্ছে কালো। ফলে পাটের বাজার দরও কম পাচ্ছেন পাট চাষিরা। উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের পাটের চেয়ে মন প্রতি তিন থেকে চারশ টাকা কম পাচ্ছেন তারা। এতে লোকসানের মুখে পড়ছেন জেলার হাজার হাজার কৃষক।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব মতে জেলায় এবার প্রায় ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৮৮ হাজার মেট্রিকটন পাট উৎপাদন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। জেলা কৃষি বিভাগ বলছে- লোকসান কমাতে কাদা মাটি বাদ দিয়ে মুক্ত জলাশয়ে পাট জাগ দিতে হবে। আর কৃষকেরা বলছেন- বর্তমানে জেলার কোথাও উন্মুক্ত জলাশয় নেই বললেই চলে। মেহেরপুর জেলায় সাধারণত ভারতীয় ও দেশি তোষা জাতের পাটের চাষ হয় বেশি। তবে পাট চাষের বড় অন্তরায় পানি। এক সময় জেলার ভৈরব, কাজলা, ছেউটিয়া নদীতে প্রচুর পানি থাকতো। বইতো স্রোত। চাষিরা এসব নদীর স্রোতের পানিতে পাট জাগ দিতো। তাতে পাটের রঙ হতো সোনালী। খরচও হতো অনেক কম। পাশাপাশি অনেক খাল-বিল ছিলো যেখানে পাট জাগ দেয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে পর্যাপ্ত বৃষ্টি নেই এবং ওই সব নদী, খাল-বিলের বেশির ভাগ ভরাট হয়ে গেছে। তাই কোথাও স্রোতের পানি বা মুক্ত জলাশয় নেই।

মেহেরপুর সদর উপজেলার উজলপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল কুদ্দুস, কফিল উদ্দিন, ছেকেন আলীসহ আরও অনেকে জানান- বর্তমানে পাট জাগ দেয়ার মুক্ত জলাশয় বলতে কিছু নেই। নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে ভৈরব নদীর খনন কাজ চলছে- তাই সেখানে পাট জাগ দেয়া নিষেধ। বিলগুলোতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমিতির মাধ্যমে মাছ চাষ করা হচ্ছে। তাই বিলেও পাট জাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাধ্য হয়ে পুকুর, ডোবা, নিচু জলাশয় ভাড়া নিয়ে পাট জাগ দিতে হচ্ছে। ভাড়া নিতে অনেককে আবার সিরিয়াল দিতে হচ্ছে। সেখানে শ্যালোইঞ্জিনের সাহায্যে পানি জমিয়ে কাদা-মাটি চাপা দিয়ে পাট পঁচাতে হচ্ছে। এতে প্রতি বিঘা জমির পাট পঁচাতে বাড়তি এক হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। আবার বদ্ধ পানিতে কাদা-মাটি দিয়ে পাট জাগ দেয়ার কারণে পাটের রঙ কালো হচ্ছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা। পাট চাষ থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত বিঘাপ্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এ বছর বৃষ্টির অভাবে সেচ খরচ হয়েছে অনেক বেশি এবং পাট লম্বাও হয়েছে কম। তাই পাট বিক্রি করে খরচ উঠবে না। এক বিঘা জমির পাট বিক্রি করে কৃষকেরা পাচ্ছেন কোনো রকমে উৎপাদন খরচের সমান বা তার চেয়ে কম। তবে জমি লিজ নেয়া হলে লিজের টাকা ঘর থেকে দিতে হবে।

মেহেরপুরের কৃষকরা আরও জানান- পাটের রঙ এবং মান ভালো হওয়ায় উত্তরবঙ্গের পাটের দাম এখানকার চেয়ে মণ প্রতি তিন থেকে চারশ টাকা বেশি। তাই তাদের পাটে লোকসান হবে না। এখানে খোলা স্রোতের পানিতে পাট জাগ দেয়ার সুযোগ থাকলে কৃষকেরা লাভবান হতেন।

মেহেরপুর গাংনী উপজেলার কুঞ্জনগর গ্রামের পাট চাষি আশরাফুল ইসলাম জানান- কৃষি অফিস পলিথিন, বালি ও বস্তা ভর্তি ইট দিয়ে পাট জাগ দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু জায়গা ও সময় স্বল্পতা ছাড়াও এটি ব্যয় বহুল হওয়ায় চাষিরা কেউ এ পরামর্শ মানছেন না। একই কথা জানালেন গাংনী উপজেলার বাথানপাড়ার কোরবান আলী ও রাইপুরের মকলেছ মাস্টার।

এদিকে পাটব্যবসায়ী তানজিলুর রহমান জানান, তিনি বিভিন্ন জেলা থেকে পাট কিনে দেশের বিভিন্ন মিলে পাট বিক্রি করে থাকেন। এখানকার পাটের স্থায়িত্ব কম। অন্যদিকে কাদামাটি দিয়ে পাট জাগ দেবার কারণে পাটের রঙ হয় কালো। ফলে মিল মালিকরা কাঙ্ক্ষিত দাম দিতে চান না এখানকার পাটের। উত্তরবঙ্গের জেলাতে পাট বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ১৬০০ থেকে ১৬৫০ টাকায, ফরিদপুর অঞ্চলের পাট বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ১৭৫০ থেকে ১৮০০ টাকায়য় আর মেহেরপুরের পাট বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ১৩০০ থেকে ১৩৫০ টাকা করে।

সমস্যার কথা স্বীকার করে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এসএম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কাদামাটি দিয়ে পাট জাগ না দিয়ে পাটের জাগের ওপর ইট অথবা পলিথিনে মাটি ভর্তি করে জড়িয়ে রাখতে হবে। তাহলে পাটের রঙ কালচে হবে না। এছাড়াও মুক্ত জলাশয়ে পাট পাট জাগ দেয়ার পরামর্শ তাদের।

এদিকে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মেজবাহুল হক জানান- পাট জাগ দেয়ার ফলে দেশীয় মাছ উৎপাদন ব্যাহত হয়। দেশি মাছ বৃদ্ধি যেন ব্যাহত না হয় সে কারণে মুক্ত জলাশয়ে পাট পঁচানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা করা হয়েছে।