নিহত আলমডাঙ্গার রাশেদের বাড়িতে থামছে না কান্নার রোল

 

ফলো আপ: পানিপথে মালয়েশিয়া নেয়ার পথে পিটিয়ে সাগরে ফেলে হত্যা

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: কিছুতেই কান্নার রোল থামছে নাআলমডাঙ্গার নগরবোয়ালিয়া গ্রামের কিশোর রাশেদ খানের বাড়িতে।প্রতিদিনই বিভিন্ন গ্রাম থেকে পানিপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানো নিখোঁজ যুবকদের পিতা-মাতা রাশেদ খানের বাড়িতে গিয়ে কান্নার মাতমে শরিক হচ্ছেন।মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে পানিপথে নৌকায় করে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার পথে আলমডাঙ্গার নগরবোয়ালিয়া গ্রামের রাশেদ খান নামের ওই কিশোরকে পিটিয়ে সাগরে ফেলে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করেছে।

জানাগেছে, আলমডাঙ্গা উপজেলার নগরবোয়ালিয়া গ্রামের ঠাণ্ডু খানের ছেলে রাশেদ (১৬), হাটবোয়ালিয়া ও গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুরের ১০ কিশোরকে অন্যান্য প্রায় ৩শ কিশোরের সাথে পানিপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো।ওই কাফেলার একজন যাত্রী ছিলেন হেমায়েতপুরের মকছেদ আলীর ছেলে ইকতার আলী।মালেয়শিয়া থেকে তিনি গত ২৬ এপ্রিল মোবাইলফোনে জানিয়ে দেন, হেমায়েতপুরের শুকুরের ছেলে জাহিদ দালাল তাদেরকে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়ায় মালেয়শিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়।গত ২ এপ্রিল তাদেরকে টেকনাফ থেকে অন্যান্য প্রায় ৩শ জনের সাথে বড় নৌকায় করে সমুদ্রপথে মায়ানমারে নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে থাইল্যান্ডে নেয়া হয়। দীর্ঘ পথ যেতে প্রায় ৬ দিন সময় লাগে।৩ তলা নৌকায় সকলকে চেয়ারে বসিয়ে কোনোপ্রকার নড়াচড়া করতে না দিয়ে অমানবিকভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।একদিন পরপর শুধু যারা ওপরের তলায় ছিলোতাদের নিচে আর নিচেরগুলো ওপরে থাকতে দেয়া হতো পালাক্রমে। সারাদিনে একমুঠো শুকনো চিড়ে ও এক মুটকি পানি দেয়া হতো।এমন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে ৪ দিন অতিবাহিত হলে ক্ষিধের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে রাশেদ চেঁচামেচি গালিগালাজ করতো। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দালালেরা তাকে বেদম মারধর করে সাগরের পানিতে ফেলে দেয়। শুধু রাশেদকেই ফেলেনি সাগরে। অচেনা আরও ৬ কিশোরকেও সাগরে ফেলে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের এ পরিণতি দেখে বাকি সকলেই ভয়ে আতঙ্কে টু শব্দ না করে কোনোভাবে প্রাণ নিয়ে থাইল্যান্ডেপৌঁছেছে।থাইল্যান্ড থেকে সীমান্ত পথে তারা মাত্র ৪ জন মালয়েশিয়া ঢুকতে পেরেছে। বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা তিনি জানেন না।

নিহত রাশেদের পরিবার জানিয়েছে,রাশেদের পরিবার তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি মোটেও জানতেন না।২ এপ্রিল ভোরে হাটবোয়ালিয়ার উম্মত নাপিত রাশেদকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে গ্রামের অনেকেই জানায়, রাশেদকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর দীর্ঘদিন ছেলের খবর না পেয়ে তারা দালাল জাহিদের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি প্রত্যেক বারই রাশেদ ভালো আছে বলে জানিয়েছেন। ছেলের সাথে কথা বলিয়ে দেয়ার দাবি করলে আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে কালক্ষেপণ করতো। এরই মাঝে হেমায়েতপুরের ইকতারের সাথে মোবাইলফোনে কথা বলে তারা রাশেদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানতে পারেন।

উল্লেখ্য,গত বছরও জাহিদ দালাল স্থানীয় কয়েকজন দালালের সহযোগিতায় হাটবোয়ালিয়ার ইয়াকুবের ছেলে শাহজালাল,হেমায়েতপুরের কালুসহ ভাংবাড়িয়ার ৩ জন,চাঁদপুরের ৩ জন,মানিকদিয়ার ৫ ও এলাঙ্গীর ৩ জনসহ ২৫ জন কিশোরকে বিনা পাসপোর্ট ভিসায় সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। দীর্ঘ ১ বছরেও তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।ওই ঘটনার পর থেকে আর জাহিদ দালাল এলাকায় আসে না। তবে এলাকার দালালদের মাধ্যমে বেশ ঘটা করে রাশেদের কুলখানি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে জানা গেছে। হাটুভাঙ্গার আকিমুদ্দীন,ভাংবাড়িয়ার শহিদুলসহ হাটবোয়ালিয়ার আকতারুল, নগরবোয়ালিয়ার মনোয়ারসহ বেশ কয়েকজন দালালকে দিয়ে সে কিশোর ধরার জাল ফেলে বলে এলাকার অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন।

আলমডাঙ্গা ও পার্শ্ববর্তী গাংনী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোরদের মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই গত কয়েক বছর ধরে গোপনে বিদেশে পাচার করে আসছে একটি সংঘবদ্ধচক্র। হাটবোয়ালিয়া, হাটুভাঙ্গা,ভাংবাড়িয়া, হারদী ও গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুরসহ বেশ কিছু গ্রামে এদের স্থানীয় দালাল রয়েছে। মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে কোনো টাকা দেয়া লাগবে না। থাইল্যান্ডে পৌঁছে টাকা দিলেই যাওয়া হবে।এমনকি যেতে সরকারিভাবে অনেক সময় ও অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়। কিন্তু অবৈধভাবে যেতে এ সব সমস্যা নেই। এমন চটকদার কথা বলে স্থানীয় দালালেরা গোপনে কিশোর শিকার করে থাকে। কয়েক মাস আগে এ চক্রটি স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় আলমডাঙ্গা উপজেলার ওসমানপুর-প্রাগপুরের হাতিবংশের বেশ কয়েকজন কিশোরকে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে।পানিপথে চুরি করে তাদেরকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। এলাকাসূত্রে জানা গেছে, তাদের মধ্যেও বেশ কয়েকজনের আর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে,গত ২৮ এপ্রিল রাশেদের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকে তার পরিবারসহ পাড়ায় শুরু হয় শোকের মাতম। অন্যদের সংবাদ না পেয়ে তাদের পিতা-মাতাসহ আত্মীয়রাও রাশেদের বাড়িতে গিয়ে শোকের মাতমে শরিক হচ্ছেন। এমনকি গত বছর যে ২৫ জন ছেলেকে পাসপোর্ট ও ভিসাবিহীন পানিপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে,সেই সব নিখোঁজদের পিতা-মাতারাও দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে গিয়ে প্রতিদিন কেউ না কেউ রাশেদ খানের বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটিতে যোগ দিচ্ছেন। বুক ভাঙা আর্তনাদে সামিল হচ্ছেন। কোনোভাবেই সে কান্নার রোল বন্ধ হচ্ছে না।