নিখোঁজের ৫ মাস পর : বরিশাল থেকে মেহেরপুর নানির হেফাজতে গেলো মাতৃহীন প্রতিবন্ধী শিশু হৃদয়

 

মেহেরপুর অফিস: নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ৫ মাস পরে নানির হেফাজতে ফিরেছে মেহেরপুরের মাতৃহীন প্রতিবন্ধী শিশু হৃদয় (১৪)। মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের (মউক) সহযোগিতায় অপরাজিতা বাংলাদেশ’র বরিশাল সেন্টার হোম’র প্রতিনিধিরা গতকাল রোববার বিকেলে হৃদয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে তার নানির কাছে তুলে দেন। এ উপলক্ষে মউক’র সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় শিশু হৃদয়ের জীবন মানোন্নয়নের জন্য ৫ সদস্যের কমিটি গঠনসহ অপরাজিতা বাংলাদেশ ও মউক’র পক্ষ থেকে হৃদয়ের পুনর্বাসন সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়।

মেহেরপুর জেলা শহরের বেড়পাড়ার অটোরিকশা চালক জাকির হোসেনের ছেলে শুভ ওরফে হৃদয় শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু। হৃদয় ও তার ছোট বোন স্কুলছাত্রী বৃষ্টিকে রেখে তাদের মা মারা যাওয়ার পর হৃদয় তার নানি শহরের তাহের ক্লিনিকপাড়ার রিজিয়া বেগমের নিকট থাকতো। প্রায় ৫ মাস আগে হৃদয় শহর থেকে হারিয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িসহ সম্ভব্য সব জায়গার খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। হৃদয়কে অপহরণ করে ভারতে পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করেছিলেন আত্মীয়স্বজনরা।

প্রায় দু মাস আগে হৃদয়ের নানা হান্নান শাহ এবিষয়টি মউক’র টার্স্ক ফোর্স সদস্য নাসিরা আক্তারকে অবহিত করেন। ওই খবরের প্রেক্ষিতে মউক’র মোবাইল হটলাইনের মাধ্যমে সারাদেশে নিখোঁজ হৃদয়ের জীবনবৃত্তান্ত ও তথ্য ছড়িয়ে দেয়া হয়। এতে এক সপ্তাহ আগে অপরাজিতা বাংলাদেশ’র বরিশাল হোম সেন্টার থেকে প্রতিবন্ধী হৃদয়ের অবস্থানের প্রাথমিক তথ্য পান মউক। মউক’র পক্ষ থেকে তথ্য আদান প্রদান শেষে হৃদয়ের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে মউক’র সভাকক্ষে হৃদয়কে তার নানি রিজিয়া বেগমের হেফাজতে দেয় হয়। এউপলক্ষে এক সভায় সভাপতিত্ব করেন এডুকেশন ওয়াচ গ্রুপের সদর উপজেলা সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আলহাজ মো. আব্দুল হান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট রফিক-উল আলম, অপরাজিতা বাংলাদেশ’র বরিশাল সিপিডি প্রকল্পের সমাজকর্মী লুৎফন নেছা রীনা। বক্তব্য রাখেন মউক’র নির্বাহী প্রধান আশাদুজ্জামান সেলিম,অপরাজিতা বাংলাদেশ’র বরিশাল সিপিডি প্রকল্পের শিশু উন্নয়ন কর্মী আব্দুল কাদের, হৃদয়ের পিতা জাকির হোসেন, নানী রিজিয়া বেগম প্রমুখ।

অপরাজিতা বাংলাদেশ’র বরিশাল সিপিডি প্রকল্পের শিশু উন্নয়নকর্মী আব্দুল কাদের শিশু হৃদয়ের হৃদয় বিদারক উদ্ধার কাহিনীর বর্ণনা দিলেন। তিনি বললেন, গত ৩ জুন লোকমুখে জানতে পারলেন ৩ দিন ধরে বরিশাল শহরের একটি চায়ের দোকানের পাশে পড়ে আছে মৃতপ্রায় একটি শিশু। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন চায়ের দোকান আছে ঠিকই। কিন্তু দোকানটি খোলা হয়না। তার পাশে লুঙ্গি পড়ার ময়লা-নোংরার মধ্যে পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে একটি শিশু। তাকে উদ্ধারের সময় তার গায়ে ছিলো পিপড়া, তেলাপোকা (আরশোলা), পাশের ইঁদুর-ছুঁচো’র বাস। তিনি শিশুটি উদ্ধার করে ভিজা কাপড়ে মুছে সহকর্মীদের সহযোগিতায় বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন সে শুধু তার নাম হৃদয় বলে জানায়। তিনি আরো বললেন, উদ্ধারের সময় শিশুটি পাশে কিছু শুকনো খাবার পড়ে থাকতে দেখেছেন তিনি। গায়ে ঘা আর রোগে ভরা শরীর নিয়ে সে যখন চলতে পারছিলো না হয়তো তখন সে খাওয়া ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলো। বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরো জানান, হৃদয় যখন খাওয়া শুরু করে তখন সে মুরগির মতো খাবার মুখ দিয়ে তুলে খেতো। পরবর্তীতে সে হাতে চামচ ধরে খাওয়া শুরু করে। তার চিকিৎসা চলছে এবং এখনো চিকিৎসা বাকি আছে। চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, শুনেছিলাম শিশুটি কিছুদিন ধরে বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষে করে খেতো।ছেলেকে কাছে পেয়ে চোখের পানি সংবরণ করতে পারছিলেন না পিতা অটোরিকশাচালক জাকির হোসেন। আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে অপরাজিতা বাংলাদেশ’র বরিশাল সিপিডি প্রকল্প ও মানব উন্নয়ন কেন্দ্রকে (মউক) ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, হৃদয়ে মা হৃদয়ের ৫ বছর বয়সে মারা গেছেন। তাই প্রতিবন্ধী হৃদয়কে সৎ মায়ের সংসারে না রেখে নানির কাছে রাখা হয়েছে।

নানি রিজিয়া বেগম নাতি হৃদয়কে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, হৃদয় আমার টাকার সুদ। তাই সে অনেক মিষ্টি। ভাই তুই কোথায় ছিলি?তোকে আর আমি হারাতে দেবনা।

অনুষ্ঠানে শিশু হৃদয়ের জীবন মানোন্নয়নে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিউনিটি কেয়ার কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সদস্যরা হলেন- আলহাজ আব্দুল হান্নান, মহাসিন আলী, জালালউদ্দিন, আবু লায়েচ লাভলু ও হাফেজ আব্দুল আলীম। অনুষ্ঠানে অপরাজিতা বাংলাদেশ’র পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী শিশু হৃদয়কে প্রতিবারে ১২ হাজার টাকা করে ৩ বারে ৩৬ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়। মউক’র পক্ষ থেকেও তাকে পুনর্বাসনের ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া আলহাজ আব্দুল হান্নান প্রতি বছর ঈদে তাকে এক হাজার টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দেন।সব শেষে মেহেরপুর সদর থানায় উপস্থিত হয়ে শিশু হৃদয়কে তার নানির হেফাজতে দেয়া হয়েছে বলে পুলিশকে অবহিত করা হয়।