নারীদের আয়ে বদলে যাচ্ছে আলমডাঙ্গার আদিবাসী সমাজ

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: রাজনৈতিক কারণে হরিজন আখ্যা দেয়া হলেও বঞ্চিত ও অবহেলিত এক জনগোষ্ঠী আলমডাঙ্গার ব্যাদ-কোলসহ আদিবাসী সম্প্রদায়। যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়। অন্যের বাড়িতে কাজ করা, রাস্তাঘাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঝাড়ু দেয়া, ড্রেন পরিষ্কার, মল-মুত্র পরিষ্কার, পাখি শিকার, মাছ ধরা ও নিম্নমানের শ্রম বেচাই যেন তাদের নিয়তি। আর মেয়েদের নিয়তি অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করা। নিচু জাত বলেতাও আবার সব বাড়ির কাজ কপালে জোটে না! তবুও এসব কাজ করেই যুগ যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলো তারা। ফলে তাদের কপালও ফিরছিলো না। হচ্ছিলো না অবস্থার পরিবর্তন। কখনও খেয়ে, কখনও না খেয়ে দিন কাটতো তাদের। অপুষ্টি, অসচেতনতা, অচিকিৎসা আর অশিক্ষার ঘেরাটপে বন্দি ছিলো তাদের নিয়তি। আর এসবই তারা মেনে নিচ্ছিলো অদৃষ্টের লেখা ভেবে!

বিস্ময়কর কথা হলো এ এলাকার আদিবাসীরা কিছুদিন পূর্বেও ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর কথা ভাবেনি! তাই তাদের ছেলে-মেয়েরাও থেকে যেতো নিরক্ষর। বঞ্চিত হচ্ছিলো মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে। তবে বর্তমানে ধীরে ধীরে অধিকারের বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন তারা। তাদের অবহেলিত সমাজেও লাগতে শুরু করেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। ফলে বদলে যেতে শুরু করেছে আলমডাঙ্গার আদিবাসী সমাজ। বেশ কয়েক বছর ধরে এখানকার আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে কেউ কেউ পড়ছে। সকলকে বিস্মিত করে ব্যাদ সম্প্রদায়ের জয় কুমার ব্যাদ তো দু বছর আগে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করে নেয়। বর্তমানে সে আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি’র ২য় বর্ষের ছাত্র। তার ছোট বোন বর্ষা রানী আলমডাঙ্গা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী। পিএসসিতে সেও জিপিএ-৫ পাবে বলে তার শিক্ষকরা দৃঢ় আশাবাদী। সন্তোষ কুমার ব্যাদের ছেলে রাজিব কুমার ব্যাদ তো আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। সংস্কৃতিক চর্চায়ও সে নিবেদিতপ্রাণ। গানের গলাও চমৎকার। যমজ ভাই কুশ কুমার ব্যাদ ও লব কুমার ব্যাদ। কুশ কুমার ব্যাদ কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বোটানিতে অনার্স পড়ছে। আর অপর ভাই লব কুমার ব্যাদ কৃষিতে ডিপ্লোমা শেষে বর্তমানে আলমডাঙ্গা ডিগ্রী কলেজে ডিগ্রি পড়ে। প্রভাত ব্যাদের ছেলে ঢাকায় অনার্স পড়ে। সিভাষ কুমার ব্যাদের ছেলে নির্মল কুমার ব্যাদ চুয়াডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজে অনার্স পড়ে। এধরনের অনেক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীর বর্তমান প্রজন্ম। তাদের চোখে-মুখে আকাশ ছোঁয়ার সোনালী স্বপ্ন। এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।এদের বেশির ভাগই কর্মজীবী।বিভিন্ন ধরনের হস্ত শিল্পের কাজ করেই তারা পড়ালেখার খরচ যোগান। তারা অবশ্য সফল হয়েছেন, হচ্ছেন। আর এ সফলতার মূলে রয়েছেন নারীরা, তাদের মায়েরা।সরকারি কোনো সহযোগিতা না থাকলেও কিছু এনজিও তাদের সচেতন ও উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। স্বামীর পাশে স্ত্রীরাও সংসারের হাল ধরছেন। এখানকার নারীরা বাঁশ ও বেতের কাজ করে ভালোই আয় করছেন।

রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি তাদের পণ্য কিনে নিয়ে যায়।পুরুষরা সাধারণত যা উপার্জন করেন,তার অধিকাংশই ঐতিহ্য অনুযায়ী মাদকাসক্ত।উপার্জনের পুরোটাই প্রায় এ পথে ব্যায় হয়।নারীদের আয়েই ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা শিখছে। জুটছে সংসারের অন্য খরচও।

আলমডাঙ্গা এলাকার আদিবাসীদের ইতিহাস খুব একটা পুরাতন নয়। আলমডাঙ্গার আদিবাসীরা ব্যাদ, কোল, বুনো, বাগদি ও ঋষি বলে পরিচিত।জানা যায়, ব্রিটিশ ইংরেজ নীলকরদের নীলচাষ প্রতিষ্ঠা এবং তা টিকিয়ে রাখতে লাঠিয়াল বাহিনীর প্রয়োজন হতো। কিন্তু এদেশের মানুষ লাঠিয়াল বাহিনীতে যোগ দিতো না। তাই এসব আদিবাসীকে এ দেশে ধরে আনা হয়। এ কাজটি করেছিলো ব্রিটিশ নীলকররা। ব্রিটিশ শাসন অবসান হওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যায় নীলচাষ। ফলে তারা কর্মহীন হয়ে পড়ে। জীবিকার তাগিদে পেশা ছেড়ে পাখি শিকার, ঝিনুক কুড়ানো, মলমূত্র পরিষ্কার ও মাছ ধরাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয় তারা। তাদের পুনর্বাসনে সরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়না। তবে বেশ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কাজ করছে।এ সম্প্রদায়ের মেয়েরা তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাঁশ-বেত দিয়ে সংসারের বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে তারা এখন স্বাবলম্বী।

এক সময়ের অসচ্ছল গৃহিণী রজনী রানী জানান, দিনমজুর স্বামী পরানের উপার্জন সামান্য। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভালোভাবে সংসার চলছিলো না। ফলে তাদের দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিলো না। এ দুর্বিষহ সময়ে এক এনজিওর ম্যানেজারের সাথে তার পরিচয় হয়। তার সহযোগিতায় অন্যান্য নারীদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন একটি ভূমিহীন মহিলা সমিতি।ঝণ নিয়ে বাঁশজাত শিল্পের কাজ শুরু করেন তারা।। শুরু করেন কুলা, ডুলা, চালনি, মাছ ধরার বিভিন্ন রকম উপকরণ, চাই ও গৃহস্থালির নানা সামগ্রী তৈরির কাজ। এতে তার ভালোই আয় হয়। সংসারে আসে সচ্ছলতা। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য নারীরাও শুরু করেন বাঁশজাত শিল্পের কাজ। এরপর তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে আদিবাসী নারীরা বাঁশজাত পণ্য তৈরি করে দারিদ্র্য জয় করেছেন। এখন তারা এলাকায় রীতিমতো মডেলে পরিণত হয়ে উঠছেন। আনারকলি রানীর আগে সংসারে অভাব ছিলো নিত্যসঙ্গী। স্বামীর আয়ে সংসার চলতো না। এখন তিনি আয় করায় বেশ ভালো আছেন। আদিবাসী ঋষিদের ঘরে ঘরে এখন জ্বলছে শিক্ষার আলো। এখন এই আদিবাসী এলাকায় সন্ধ্যা নামলেই ঘরে ঘরে ছোট ছেলে-মেয়েরা বই নিয়ে বসে যায় পড়ার টেবিলে।

এখানকার নারীরা এখন যথেষ্ট পরিবেশ সচেতন। সাংবাদিক রহমান মুকুল বলেন, আদিবাসীরা এ ভূখণ্ডের আদি ভূমিপুত্র।স্থানীয় কিংবা বহিরাগত মুসলমান কিংবা হিন্দু সম্প্রদায় কেউই এদের প্রাপ্য সন্মান দেয়নি।অচ্ছ্যুত ভেবে এসেছে।পাল,মোগল,ইংরেজ,পাকিস্তানি কিংবা বাংলাদেশকোনো শাসনামলেই এরা গুরুত্ব পায়নি। নির্লজ্জভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে।এদের প্রতি এখনো আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি বেদনাদায়ক পশ্চাদমুখি।অবশ্য নিজ যোগ্যতায় এরা এখন সমাজের মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যেটা ১ যুগ আগেও এতোটা সহজ ছিলো না।এখন তো এ সম্প্রদায় নিজেরা মণ্ডপ তৈরি করে পৃথকভাবে পূজা-অর্চনাও করছে। আলমডাঙ্গা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারেজ উদ্দীন অবাক করে দিয়ে বলেন, এখন তো আদিবাসী সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মের অনেকে নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্যের ব্যাপারে বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে।নিজেদের ইতিহাস নিয়ে অনেকে রীতিমত গর্বও করে।এসএসসিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত জয় কুমার ব্যাদ তো তার নামের পূর্বে ব্যাদ না লিখলে রীতিমত প্রতিবাদ করে।সব মিলিয়ে অনেকটাই বদলে গেছে আলমডাঙ্গার আদিবাসীদের জীবনমান। আর এর মূলে রয়েছে নারীদের কঠোর পরিশ্রম।