ধর্মান্তরিত ওজাকি সপরিবারে সিরিয়ায়

 

স্টাফ রিপোর্টার: ৱ্যাবের পক্ষ থেকে নিখোঁজদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তার মধ্যে আছেন জাপান প্রবাসী সাইফুল্লাহ ওজাকি। এই তালিকা প্রকাশের পরই উঠে এসেছে ওজাকির আসল পরিচয়। ধর্মান্তরিত এই ওজাকি জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। জাপানী নারীকে বিয়ে করেছিলেন। পাঁচ সন্তানের জনক ওজাকি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। এখন তিনি সপরিবারে অবস্থান করছেন সিরিয়ায়। যোগ দিয়েছেন আইএসে। অথচ বাংলাদেশে থাকা তার পরিবার কিছুই জানে না। ছয় মাস ধরে পরিবারের সঙ্গে নেই কোনো যোগাযোগ। ১৪ মাস আগে এসেছিলেন দেশে। তখনও কেউ বুঝতে পারেননি এই মেধাবি বাঙালি তরুণ নষ্ট হয়ে গেছে। পচে গেছে তার মস্তিষ্ক। ইসলাম রক্ষার নামে সন্ত্রাসীদের হাত ধরে তাদের পথেই চলে গেছেন উচ্চ শিক্ষিত এই তরুণ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার কড়ুইবাড়ি গ্রামের জনার্ধন দেবনাথের ছেলে সুজিত চন্দ্র দেবনাথ এই সাইফুল্লাহ ওজাকি। জাপানে যাওয়ার পরই ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিয়ে করেন জাপানী নারীকে।

জনার্ধন দেবনাথ বলেন, গত ছয় মাস ধরে আমাদের সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। শেষ পর্যন্ত সে জাপানে থাকত বলেই জানতাম। এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানি না। পরিবারের কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না, আমাদের ছেলে সুজিত সন্ত্রাসী কোনো গ্রুপে যোগ দিয়েছে। সে অত্যন্ত মেধাবী। এলাকার সবাই তাকে নম্র ও ভদ্র বলেই জানে। সত্যিই আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না, আসলে কি হয়েছে, কি হচ্ছে। ছেলের জন্য প্রতিদিনই কাঁদছেন মা। নানাভাবে চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

এই সুজিত চন্দ্র দেবনাথ সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০১ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপান যান। সেখানে তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নাম হয় সাইফুল্লাহ ওজাকি। জাপানি নারীকে বিয়ে করে জাপানের নাগরিকত্ব নেন তিনি। এই দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় চার ছেলে ও এক মেয়ে। ধর্মান্তরের পর বাংলাদেশে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা ওজাকি ২০১১ সালে পিএইচডি করে রিসুমেকান ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অনুপস্থিত থাকায় গত মার্চে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করে বলে জাপান টাইমস জানিয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে কিয়োদো নিউজ জানিয়েছে, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ইউরোপ হয়ে সিরিয়া পাড়ি দিয়েছেন সাইফুল্লাহ ওজাকি।

সংবাদ সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুল্লাহ ওজাকি ২০১৫ সালের ১৫ মে তুরস্কের ইস্তাম্বুল হয়ে সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন জাপান ফিরে আসার পর পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তবে তখন উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সাইফুল্লাহ ওজাকির কোনো রকম যোগসাজশ না পাওয়ার কথা জানিয়েছিলো জাপান পুলিশ। তার দুই মাস পর সিরিয়ার শরণার্থীদের সহায়তা করার কথা বলে ইউরোপ যান সাইফুল্লাহ। সেখান থেকে স্ত্রী-সন্তানসহ তিনি সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট অধ্যুষিত এলাকায় চলে যান বলে কিয়োদো নিউজের খবর। জাপানের শিগা প্রদেশের কুসাতু সিটির রিসুমেকান ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সময় ওজাকি যে ফোন ব্যবহার করতেন, সেখানে কল করে তাকে পাওয়া যায়নি।

কিভাবে আইএসে যোগ দিলেন ওজাকি: জাপানের আর্কাইভ ডট ওরাজি ওয়েবসাইটে সুজিতের নামে একটি গবেষণাপত্র পাওয়া গেছে। যোগাযোগ সাময়িকী প্রোসিডার ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তার একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। এরপরই তিনি উগ্রবাদী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের সংস্পর্শে আসেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাপানের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাপানের ডশিসা ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক হাসান কো নাকাতার সংস্পর্শে এসে আইএসে যুক্ত হন সাইফুল্লাহ ওজাকি। জাপানের জাতীয় পুলিশ সংস্থা (এনপিএ) বলছে, নাকাতা গাঢাকা দিয়েছেন। তাকে খুঁজতে পুলিশ কাজ করছে। ১৯৭৯ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী হাসান নাকাতা আইএসের হয়ে কাজ করছেন বলে নিশ্চিত হওয়ার কথা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান।

টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক এবং মিসরের কায়রো ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নেয়া নাকাতা ডশিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ২০০৩ সালে। সৌদি আরবে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করে আসা নাকাতা এরপরই হিযবুত তাহরিরে যোগ দেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়। সংগঠনটির বিভিন্ন কার্যক্রমে তার যুক্ত থাকার প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আছে।

২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি জাপানের দুই সাংবাদিক আইএসের হাতে আটক হলে জাপান সরকার নাকাতাকে সিরিয়া পাঠায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবেদনে তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইএসের চেচেন যোদ্ধা ওমর গুরবার মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমঝোতার চেষ্টা চালালেও মন্ত্রণালয় যথাযথ ভূমিকা নেয়নি। এরপর থেকে নাকাতার আইএসের সাথে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ সম্বলিত কয়েকটি ছবি আসে গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএস স্টাডি গ্রুপের ওয়েবসাইটে। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, গত ১৪ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে নাকাতার সাথে সাইফুল্লাহ ওজাকির দেখা করার তথ্যও আমরা পেয়েছি।