দ্বিতীয় ময়নাতদন্তেও তনু হত্যার কারণ চিহ্নিত হয়নি

স্টাফ রিপোর্টার: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তেও মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে পারেনি আদালতের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে ঘটনার পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে পুলিশকে আরও অধিকতর তদন্তের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তনুকে ধর্ষণ প্রসঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. ওমর ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, মৃত্যুর পূর্বে তনুর সাথে ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ হয়েছে এবং তার এ ধরনের অভিজ্ঞতা আছে।

রোববার দুপুরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা এসব তথ্য জানান। এর আগে বেলা ১১টার দিকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ হতে সিআইডির কুমিল্লা কার্যালয়ে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়। এদিকে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত রিপোর্টের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছেন তনুর বাবা-মা ও স্বজনরা।

উল্লেখ্য, কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশ গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়। সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত শেষে পরদিন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে তার প্রথম ময়নাতদন্ত করেন ওই কলেজের প্রভাষক ডা. শারমিন সুলতানা। তিনি হত্যাকাণ্ডের ১৬ দিনের মাথায় ৪ এপ্রিল প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন তার দফতরের বিভাগীয় প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহার কাছে হস্তান্তর করেন। পরে কামদা প্রসাদ সাহা গণমাধ্যমে প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এতে তনুর মৃত্যুর কারণ উল্লেখ ছিল না এবং ধর্ষণের আলামতও পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

এদিকে আদালতের নির্দেশে গত ৩০ মার্চ দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্তের জন্য তনুর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গত ১৪ মে কুমিল্লার আদালতে এসে পৌঁছায় নিহত তনুর সাতটি বিষয়ের ডিএনএ প্রতিবেদন। গত ১৬ মে তনুর ভেজাইনাল সোয়াবে তিন পুরুষের শুক্রানু (বীর্য) পাওয়া যায়। তনুর ডিএনএ পরীক্ষায় আলামত পাওয়ায় প্রতিবেদনটি দেয়ার জন্য সিআইডিতে চিঠি পাঠান মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা। একাধিকবার চিঠি চালাচালির পর আদালতের নির্দেশে গত ৭ জুন ফরেনসিক বিভাগের চাহিদা মোতাবেক তনুর ভেজাইনাল সোয়াব, দাঁত, চুল, অন্তর্বাস, কাপড়সহ সাতটি বিষয়ের ডিএনএ ফরেনসিক বিভাগে হস্তান্তর করে সিআইডি। এরই প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ৭৪ দিন পর রোববার দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সিআইডির কাছে হস্তান্তর করে মেডিকেল বোর্ড। রোববার বেলা ১১টার দিকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের অফিস সহায়ক ফারুক ও ডোম মাহে আলম এ প্রতিবেদনটি সিআইডি-কুমিল্লা কার্যালয়ে হস্তান্তর করে। প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন সিআইডি-কুমিল্লার এএসআই মোশাররফ হোসেন।

তবে এ প্রতিবেদন নিয়ে মুখ খুলতে চাননি মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা। সাংবাদিকদের অনেক পীড়াপীড়ির পর দুপুরে তার কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, মৃত্যুর আগে তার (তনুর) সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স (যৌনক্রিয়া) হয়েছে। দ্বিতীয়ত যেহেতু ১০ দিন পরে মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য উঠানো হয়েছে, মৃতদেহটি পচা ছিল। পচা-গলা মৃতদেহ থেকে নতুন করে ইনজুরি বোঝা সম্ভব হয়নি। পারিপার্শ্বিক অবস্থায় পুনরায় ইনভেস্টিগেশন হলে মৃত্যুর কারণ পাওয়া যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, ধর্ষণ হচ্ছে একটা লিগ্যাল টার্ম, এটা সায়েন্টিফিক টার্ম না। পেনিস লাগলেই ধর্ষণ হয়।

তনুকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে কামদা প্রসাদ সাহা বলেন, আপনারাই বুঝে নিন। মেডিকেল বোর্ডের অপর সদস্য ডা. ওমর ফারুক সাংবাদিকদের জানান, সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স ও ধর্ষণ দুটি ভিন্ন বিষয়। মৃত্যুর কতক্ষণ আগে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স (যৌনক্রিয়া) হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে যৌনক্রিয়া হয়েছে এবং তার (তনু) যৌনক্রিয়ার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি আরও জানান, সিআইডি থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ এবং দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের অন্যান্য পরীক্ষার সমন্বয়ে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এছাড়া রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে প্রাপ্ত ভিসেরা প্রতিবেদনেও ‘বিষক্রিয়ার আলামত’ পাওয়া যায়নি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দ্বিতীয়বার লাশ উত্তোলন করে মেডিকেল বোর্ড গঠনের উদ্দেশে মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা। এক্ষেত্রে অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করার পরামর্শ শুধু আদালতই দিতে পারে। এছাড়া তনুকে মৃত্যুর পূর্বে ধর্ষণ করার বিষয়টি সিআইডির ল্যাবে ডিএনএ পরীক্ষায় আগেই পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তকারী মেডিকেল বোর্ড তনুর মৃত্যুর কারণ ও ধর্ষণের বিষয়ে নতুন করে কোন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে পারেনি। তবে এ বিষয়ে তদন্ত সহায়ক দলের এক সদস্য জানান, তদন্ত একটি চলমান প্রক্রিয়া। ঘটনার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা হবে। আমরা হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন ও ঘাতক শনাক্তে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

এদিকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তনু হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকেই প্রথম ও দ্বিতীয় সুরতহাল রিপোর্টে গরমিল পাওয়া যায়। প্রথম সুরতহাল রিপোর্টে তনুর হাতে-পায়ে কোন জখমের বিষয় উল্লেখ না থাকলেও দ্বিতীয় সুরতহাল রিপোর্টে তার দুই হাতে, পায়ে, গলার পেছনের অংশে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তাদের মতে প্রথম ময়নাতদন্ত রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত না হওয়া, ধর্ষণ ও বিষক্রিয়ার আলামত না পাওয়া, সঠিক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতের জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলন ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ, ডিএনএ প্রতিবেদনে ধর্ষণের আলামত পাওয়া, সর্বশেষ দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে না পারা এবং মৃত্যুর আগে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদন দাখিল করাসহ বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার কারণে মামলার অগ্রগতি ও ঘাতক শনাক্ত নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এসব গরমিলের কারণে হত্যাকাণ্ডে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিয়ে সংশয়ে রয়েছে তনুর পরিবার ও স্বজনরা। বিকেলে তনুর মা আনোয়ারা বেগম সাংবাদিকদের জানান, তনুর যদি যৌনক্রিয়ার অভ্যাস থেকেই থাকে তাহলে তার চুল কেন কাটা হলো, নাক দিয়ে রক্ত আসল কেন এবং তাকে কেন হত্যা করা হলো। মেডিক্যাল বোর্ডের দেয়া দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনটিও প্রত্যাখ্যান করে তিনি আরও বলেন, ঘাতকদের বাঁচানোর জন্য ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক এ ধরনের প্রতিবেদন দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমরা তনু হত্যার সুষ্ঠু বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছি।