দেদারছে পুকুর খনন : জলাবদ্ধতার আশঙ্কা

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: সাহেবপুর-বন্দরভিটা গ্রামের মাঝামাঝি ভেড়ামারা মরানদীর সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে ব্যক্তির নামে রেকর্ড করিয়ে নিয়ে তা পানির দরে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে আলমডাঙ্গার অনুপনগর গ্রামের আনারুল ও তার বোনজামাই পিরু ওরফে সদুর বিরুদ্ধে। পানির দরে গাঙ্গের জমি কিনে দেদারছে পুকুর কাটার ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে ৭/৮টি গ্রাম ও মাঠের ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এলাকা ঘুরে জানা গেছে, আলমডাঙ্গা উপজেলার গাংনী ইউনিয়নের সাহেবপুর-বন্দরভিটা গ্রামের মাঝামাঝি অবস্থিত ভেড়ামারা মরানদী। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এ মরা নদীরও এক সময় দুরন্ত যৌবন ছিলো। মাথাভাঙ্গা নদীর খরস্রোতা অংশ ছিলো এটি। এই স্রোতশীলা নদীর বিস্তৃত পলিতে ফসলীল আবাহনও ছিলো। সে কারণে অন্যান্য গ্রামের চে’ এই নদীর তীরবর্তী নান্দবার, শালিকা, অনুপনগর, বন্দরভিটা, সাহেবপুর, রামনগরসহ অনেক গ্রামের মাঠে ফসলের ফলন ছিলো ঈর্ষনীয়। এ নদী ছিলো দু’কুলবাসীর সমৃদ্ধির আঁধার। কাল পরিক্রমায় সে নদী আজ মরানদী হিসেবে পরিগনিত। তারপরও যুগ যুগ ধরে এলাকাবাসীর অশেষ উপকার করে আসছে এই মরাগাঙ। বর্ষায় এই মরানদী হয়ে এলাকার অসংখ্য গ্রাম ও মাঠের অতিরিক্ত পানি ভাটির দিকে বয়ে যায়। ফলে মাঠ ও গ্রামগুলিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না কখনই।

কিন্তু এখন এ মরানদী অবিবেচক স্বার্থান্ধ একটি চক্রের সীমাহীন লালসায় পরিণত হয়েছে। স্বার্থান্ধ এই চক্রটি মরানদীর সরকারি খাস সম্পত্তির প্রায় ১০/১২ বিঘা জমির ব্যক্তির নামে আরএস রেকর্ড করিয়ে নিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে অপচক্রটি সেই জমি পানির দরে বিক্রি করছে। যারা কিনছেন, তাদের বেশীরভাগই মরাগাঙের বুকের ক্রয়কৃত জমি দখল নিয়ে পুকুর কাটছেন। বন্দরভিটা গ্রামের মৃত জেহের আলীর ছেলের সিদ্দিকুর রহমান, মুরাদ আলীর ছেলে ফজলুর রহমান, সাহেবপুরের মজিবর রহমানের ছেলে সায়েম আলীসহ অনেকেই মরানদীর বুকে পুকুর কেটে চিরতরে সে নদীকে হত্যার আয়োজন করেছে। ফলে খুব দ্রুত সময়েই এই মরা নদীর বুক দিয়ে আর বর্ষায় ফসলের বিস্তৃর্ণ মাঠ আর গ্রামগুলোর পানি বের হতে পারবে না। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে কয়েক শ কোটি টাকার ফসলের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, ১৯৬২ সালের এসএ রেকর্ডেও মরানদীর এই জমি সরকারি খতিয়ানভূক্ত খাস ছিলো। আরও আগে হিন্দু জেলে সম্প্রদায়ের ছিলো বলে জানতেন গ্রামবাসী। পরে তা সরকারি খতিয়ানভূক্ত হয়। কিন্তু আরএস রেকর্ড অনুপনগর গ্রামের মৃত হাজেরা খাতুনের নামে কীভাবে রেকর্ডভূক্ত হলো তা সকলের নিকটই বিস্ময়। হাজেরা খাতুনের ছেলে মৃত রবগুল অবৈধভাবে তার মায়ের নামে এই সম্পত্তি আরএস রেকর্ডভূক্ত করিয়ে নেন বলে গ্রামে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে তার ছেলে আনারুল ইসলাম ও তার ধুরন্ধর দুলাভাই একই গ্রামের মৃত খাতির মণ্ডলের ছেলে পীর মোহাম্মদ পিরু ওরফে সদু মিলে পানির দরে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট এই জমি বিক্রি করছে।

গ্রামবাসী দাবি করেছেন, বর্তমানে ওই অঞ্চলে এক বিঘা জমির দাম আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। আর এই অপচক্র জমি বিক্রি করছে মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা বিঘা। গ্রামবাসীর যুক্তি জমি যদি ন্যায্য হাজেরা খাতুনের হতো তাহলে পানির দরে বিক্রি করতো না। গ্রামবাসী জানিয়েছেন, সরকারি খাস জমি বিক্রির মূল হোতা আনারুলের দুলাভাই পিরু ওরফে সদু। এ সম্পর্কে মোবাইলফোনে পিরু ওরফে সদুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জমি আমার দাদী শাশুড়ির নামে রেকর্ডভূক্ত। আমি জমি বিক্রির সাথে জড়িত নয়, আমার শ্যালক আনারুল ইসলাম বিক্রি করছে। আপনারা তার সাথে যোগাযোগ করেন। আনারুলের সাথে মোবাইলফোনে কথা বললে তিনি বলেন, ওই জমির ব্যাপারে আমার চে’ আমার দুলাভাই ভালো জানেন। তার সাথে কথা বলেন।

এ ব্যাপারে ওই অঞ্চলের কয়েক জন ব্যক্তির সাথে কথা হয়। সাহেবপুর-বন্দরভিটা গ্রামের মেম্বার নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা ছোট বেলা থেকেই জেনে এসেছি মরানদীর ওই জমি সরকারি খাসের। কিন্তু মৃত রবগুল আলী কীভাবে তা আরএস রেকর্ডে নিজের মায়ের নামে রেকর্ডভূক্ত করিয়ে নিয়েছে। অন্যের দেখাদেখি আমি নিজেও ওই সম্পত্তি কিনে পুকুর কেটেছি। একেবারেই কম দামে পেয়েছিলাম। আমার পুকুর নদীর এক পাশে। তারপরও প্রশাসনিকভাবে এই নদীর নাব্যতা ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হলে বৃহত্তর এলাকার স্বার্থে আমার পুকুর বন্ধ করে দেব, প্রয়োজনে নিজের দখলদারিত্বও ছেড়ে দেব। তিনি স্বীকার করেন যে, নদীর বুকে বর্তমানে এভাবে পুকুর কাটার ফলে মরানদীর তীরবর্তি ৭/৮টি গ্রাম ও মাঠগুলোতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। এলাকার কৃষকদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি বন্দরভিটা গ্রামের নাসির উদ্দীন বলেন, মরানদীর খাস জমি কীভাবে ওরা ব্যক্তির নামে রেকর্ডভূক্ত করিয়ে নিয়েছে তা বলতে পারবো না। তবে মানুষ কম দামে তাদের নিকট থেকে জমি কিনে পুকুর কাটছেন। ফলে মরানদীর দিয়ে পূর্বে এই অঞ্চলের পানি বের হত, এখন তা পারবে না। সে কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই মরানদীকে সরকারিভাবে অবৈধ দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হলে তিনিও সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন।

সাহেবপুর গ্রামের মৃত জিন্দার মণ্ডলের ছেলে বয়োবৃদ্ধ কৃষক আবু মুসা বলেন, তিনিও ওই মরানদীর জমি ১৫ কাঠা কিনেছেন। একই গ্রামের মৃত আন্ধার মণ্ডলের নিকট থেকে কিনেছিলেন। সরকারি জমি কীভাবে কিনলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আরএস রেকর্ড দেখে কিনেছি। সরকার কেড়ে নিলে তো একা আমার নেবে না। সবার তাই নেবে। একই পাড়ার মৃত রুস্তম আলীর ছেলে মহাসিন আলী বলেন, মরানদীর সরকারি জমি কীভাবে রবগুল আর তার জামাই পিরু নিজের করে নিল তা বাপ বলতে পারব না। একই গ্রামের মৃত আজিজুল হকের ছেলে বয়স্ক কৃষক শিহাবুল বলেন, আগে মরানদী উন্মুক্ত ছিলো। পরে কাগজ-পাতি জাল করে রবগুল আর তার জামাই পিরু দখল করে নিয়েছে।