দামুড়হুদায় বিলুপ্তির পথে কারিগর পাখি বাবুই ও তার শৈল্পিক কুঁড়ে ঘর

 

হাসেমরেজা: ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টির, ঝড়ে। বাবুই হাসিয়া কহে, সন্দেহ কি তাই? কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়। পাকা হোক, তবু ভাই, পরেরও বাসা, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।’ এভাবেই বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসার বর্ণনা দিয়েছেন জীবন ও নিসর্গের কবি ‘রজনীকান্ত সেন’ তার কালজয়ী ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতায়। তবে আবহমান গ্রামবাংলায় এখন আর আগের মতো বাবুই পাখির সেই শৈল্পিক বাসা চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তন ও প্রকৃতির বিপর্যয়ের কারণে আজ আমরা হারাতে বসেছি সেই কারিগর পাখি ও তার শিল্প কর্মকে। বাবুই চড়ই সদৃশ পাখি। সারাবিশ্বে বাবুই পাখির প্রজাতির সংখ্যা শধাধিক। তবে আমাদের দেশে তিন প্রজাতির বাবুই পাখি বসবাস করে। এগুলো হল- বাংলা বাবুই, দাগি বাবুই ও দেশি বাবুই। গাছে ঝুরির মতো চমৎকার বাসা তৈরি করায় এ পাখির পরিচিতি জগৎজোড়া। অনেকেই একে তাঁতি পাখি ও বলেন। কথিত আছে বাবুই পাখি রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করার জন্য জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে এবং সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দেয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, এখন থেকে ১৫-২০ বছর আগে গ্রামগঞ্জের তাল, নারিকেল, ও সুপারি গাছে প্রচুর বাবুই পাখির বাসা চোখে পড়তো। বাবুই পাখির এসব বাসা শুধুমাত্র শৈল্পিক নিদর্শনই ছিলো না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জোগাত, উৎসাহ যোগাত মানুষকে পরিশ্রমী হতে।

বাবুই পাখির বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়ে বাতাসে টিকে থাকে তাদের বাসা। খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাউ, ঘাস, আখের পাতা ও কাঁশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু নারিকেল, খেজুর, সুপারি ও তালগাছে চমৎকার আকৃতির বাসা তৈরি করত বাবুই পাখিরা। একান্নবর্তী পরিবারের মতো এক গাছে দলবদ্ধ বাসা বুনে এরা বাস করে। বাবুই পাখি একাধারে স্থপতি, শিল্পী এবং সামাজিক বন্ধনেরও প্রতিচ্ছবি। বাবুই পাখির বুনন এতো শক্ত যে এ বাসা টেনেও ছেঁড়া কঠিন। এরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যায় পছন্দের সঙ্গী খুঁজতে। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সঙ্গী বানানোর জন্য কতো কিছুই না করে। পুরুষ বাবুই নিজের প্রতি আকর্ষণ করার জন্য খাল-বিল ও ডোবায় গোসল সেরে গাছের ডালে ডালে নেচে নেচে বেড়ায় আর বিভিন্ন সুরে ডাকাডাকি করে। এরপর উঁচু তালগাছের পাতার ডগায় বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। বাসার অধের্ক কাজ শেষে হলে স্ত্রী বাবুইকে ডেকে দেখায় পুরুষ বাবুই। সেটা যদি স্ত্রী বাবুই পছন্দ করে তাহলে বাসার কাজ সম্পূর্ণ করে পুরুষ বাবুই। বাবুই সাধারণত দু ধরনের বাসা তৈরি করে থাকে। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই খুবই শৈল্পিকভাবে এসব বাসা তৈরি করে। একটা বাসা তৈরিতে ১২/১৫ দিন সময় লাগে।

এপ্রিলের শেষ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এদের প্রজনন কাল। প্রজনন সময় ছাড়া অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী পাখির গায়ে কালো কালো দাগসহ পিঠ বর্ণের তামাটে হয়। নিচের দিকে কোনো দাগ থাকে না। ঠোঁট পুরো মোচাকৃতি, লেজ চৌকা। তবে প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রঙ হয় গাঢ় বাদামি। বুকের ওপরের দিক হয় ফ্যাকাশে। অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী বাবুই পাখির চাঁদি পিঠের পালকের মতোই বাদামি। বুকের কালো ডোরা ততোটা স্পষ্ট নয়। প্রকট ভ্রুরেখা কানের পেছনে একটি ফোঁটা থাকে। সঙ্গীর সাথে থেকে পুরুষ বাবুই কেবল বাসা তৈরি করে। আবার যখন স্ত্রী বাবুই ডিম দেয়ার সাথে সাথেই পুরুষ বাবুই নতুন আরেক সঙ্গীকে খুঁজতে থাকে। পুরুষ বাবুই এক মরসুমে ছয়টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করতে পারে। ঘর-সংসার করতে পারে ছয় সঙ্গীর সাথে তাতে স্ত্রী বাবুইয়ের বাঁধা নেই। প্রজনন প্রক্রিয়ায় স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়ার দু সপ্তার মধ্যে বাচ্চা ফোটে। আর তিন সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্চা ছেড়ে উড়ে যায়। বাবুই পাখির প্রজনন মরসুম হলো পাকা ধানের মরসুম। স্ত্রী বাবুই দুধধান সংগ্রহ করে এনে বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাবুই পাখির প্রধান খাদ্য তালিকায় আছে ধান, চাল, গম, পোকা-মাকড় প্রভৃতি।

এক সময় গ্রামাঞ্চলে প্রচুর তাল, নারিকেল, বাবলা গাছ ও খেজুরগাছ দেখা যেতো। আর এ সকল গাছে বাসা বেঁধে বসবাস কর বাবুই পাখি। বাবুই পাখির কিচিরমিচির শব্দ এবং তাদের শৈল্পিক বাসা মানুষকে আনন্দিত করত। কিন্তু বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের রাস্তার ধারে, বাড়ি পাশে ও পুকুর পারে সেই তালগাছ যেমন আর দেখা যায় না তেমনি দেখা মেলে না শৈল্পিক বাবুই পাখিরও। গ্রামের মাঠের ধারে, পুকুর কিংবা নদীর তীরে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে শৈল্পিক পাখি বাবুই। এখন এসব যেন বইয়ের ছড়া এবং দাদুর কাছে শোনা গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

কুড়ুলগাছির প্রবীণ শিক্ষক সমাজসেবক হাসান মাস্টার মাথাভাঙ্গাকে জানান, পরিবেশে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা এবং বড় বড় তালগাছ, খেজুরগাছ, নারিকেল গাছ ও বাবলা গাছ না থাকার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে কারিগর পাখি বাবুই। তাই বাবুই পাখি ও এর শৈল্পিক নিদর্শন রক্ষা করা জন্য দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।