ঝিনাইদহে স্কুলছাত্র হত্যার বিচার দাবি করে মামলা করায় পিতা-মাতা গ্রামছাড়া

মামলার স্বাক্ষীদেরও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে আসামিপক্ষ

 

ঝিনাইদহ অফিস: কিশোর পুত্র আল-মামুনকে হারিয়েছেন ভ্যানচালক পিতা আব্দুল মান্নান। হত্যাকারীরা পড়ার টেবিল থেকে ডেকে নিয়ে তাকে হত্যা করে মাঠের মধ্যে ফেলে রেখে যায়। সেই হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে আদালতে দরখাস্ত করেছেন অসহায় পিতা আব্দুল মান্নান। আর এ দরখাস্ত করার অপরাধে তাকে স্ব-পরিবারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। সন্ত্রাসীদের হুমকিতে স্ত্রী ও শিশুসন্তানকে নিয়ে বাড়িতে তালা লাগিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে হতদরিদ্র পরিবারটি।

শুধু আব্দুল মান্নান একা নন। আদালতে তার দায়ের করা আরজিতে যারা স্বাক্ষী হয়েছেন তাদেরকেও গ্রাম ছাড়তে হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে স্বাক্ষীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। আব্দুল মান্নানের পক্ষ অবলম্বন করায় পালাতে হয়েছে ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আমির হোসেনকেও। এবার ঈদুল আজহা পালন করতে হয়েছে তাদের বাড়ির বাইরে। এ অবস্থা ঝিনাইদহ শৈলকুপার ফুলহরি গ্রামের। গত ২৩ সেপ্টেম্বর খুন হয় ওই গ্রামের বাসীন্দা আব্দুল মান্নানের ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র আল-মামুন। মামুন সারাদিন ভ্যান চালিয়ে নিজের পড়ার খরচ নিজেই জোগাড় করতো। ঘটনার দিনও ভ্যান চালিয়ে বাড়ি ফিরে পড়তে বসেছিলো। এ সময় তার পড়ার টেবিল থেকে কে বা কারা ডেকে নিয়ে হত্যা করে।

সরেজমিনে ফুলহরি গ্রামের আল-মামুনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাদের টিনের ঘরটি তালাবদ্ধ। বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি। পাশের বাড়ির এক মহিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ছেলেটা মারা যাওয়ার পর পিতা আব্দুল মান্নান মামলা করেছেন। যে কারণে সন্ত্রাসীরা তাকেও ও তার আরেক শিশু সন্তানকে মেরে ফেলতে চেয়েছে। এ কারণে রাতের আঁধারে বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে গেছে। গ্রামের আরেক বাসীন্দা নাম প্রকাশ না করে জানান, ২৪ সেপ্টেম্বর ছেলের লাশ পান আব্দুল মান্নান। ওই দিনই পুলিশ সুরতহাল করার সময় একটি কাগজে স্বাক্ষর করে নেয়। পরে তিনি থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ জানায়, অজ্ঞাত আসামিদের নামে মামলা হয়েছে। এ মামলা মানতে পারেননি আব্দুল মান্নান। যে কারণে ২৬ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ বিচারিক হাকিম আদালত-৩ এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে একমি মামলা দায়ের করেন। আদালতে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে শৈলকুপা থানা পুলিশকে নির্দেশ দেন। ওই ব্যক্তি আরো জানান, আব্দুল মান্নান এর আরজিটি এজাহার না হওয়ায় আসামিরা সুযোগ পেয়ে যান। তারা বাইরে থেকে মান্নান ও তার পরিবারের হুমকি দিতে থাকে।

এ ব্যাপারে মোবাইলফোনে আব্দুল মান্নান জানান, মামলা করে বাড়ি ফেরার পর গ্রামের বেশ কয়েকজন তাকে জানায়, যেকোনো সময় তার বাড়িতে হামলা হতে পারে। আসামিরা সবাই সরকার দলের সমর্থনে থাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা তার ৫ বছরের আরেক শিশুপুত্রকে হত্যা করতে পারে এমন আশঙ্কায় ওই রাতেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় আব্দুল মান্নান। পরদিন সকালে গ্রামের পাতাহার আলী, তোবারক হোসেন, পিন্টু সিকদার তাকে খোঁজাখুজি করেছে। না পেয়ে তার মামলার অন্যতম স্বাক্ষী মজনু মিয়ার মুদিদোকান বন্ধ করে দিয়েছে। গ্রামের বাজারে অবস্থিত আব্দুল মান্নানের পরিবারের মনছুর আলী, জামাল মিয়া, শহিদুল ইসলাম, বজলু মিয়া, ফজলুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে তারা সবাই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

মামলার স্বাক্ষী মতিয়ার রহমান জানান, পুলিশের কাছে আসামিদের পক্ষে স্বাক্ষী দেয়ায় তিনি এলাকায় থাকতে পারছেন। বাকিদের কথা তিনি বলতে পারবেন না। এ ব্যাপারে আসামিপক্ষের পাতাহার আলী জানান, আব্দুল মান্নান তাদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। যে কারণে ২/১ জন কিছু কথা বলতে পারে। তবে তাদের কেউ মারপিট বা বাড়িতে হামলার মতো কোনো ঘটনা ঘটায়নি। যে কারণে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলে মূলত মিথ্যা মামলা করে ভয়ে পালিয়েছে। তিনি আরো বলেন, কয়েকটি দোকান বন্ধ থাকলেও তাদের অনেকে দোকান খুলে ব্যবসা করছেন। তিনি দাবি করেন ছেলেটি তাদের বাড়িতে কী কারণে মারা যাওয়ার পর লাশ মাঠে ফেলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

শৈলকুপা থানার ওসি আনোয়ার হোসেন জানান, বাদী পক্ষ আদালতে মামলা করেছেন এটা তাদের জানা নেই। তাছাড়া আদালতের কোনো নির্দেশ এখনও তারা পাননি। আব্দুল মান্নানের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান।