ঝিনাইদহের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবাবঞ্চিত সাধারণ মানুষ

 

 

করোনারি কেয়ার ইউনিট ১০ বছর ধরে বন্ধ

ঝিনাইদহ অফিস: নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও বেশিরভাগ চিকিৎসক কর্মস্থলে না থাকার কারণে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন ঝিনাইদহের সাধারণ মানুষ। সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্যও তাদের যশোর, ফরিদপুর কিংবা রাজধানীতে যেতে হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বাসস্থান থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকরা সেখানে থাকেন না। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সময়মতো অফিসে উপস্থিত না হওয়ার অভিযোগ আছে। অপারেশন থিয়েটার ও মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করার ফলে সবই বিকল হয়ে গেছে। এছাড়া জেলা সদর হাসপাতালে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত চার বেডের করোনারি কেয়ার ইউনিটটি গত ১০ বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে।

এ জেলায় সদর হাসপাতালসহ ৬টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১৩টি ইউনিয়ন পর্যায়ের সাব সেন্টার ও ১৬টি ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সরকারিভাবে মঞ্জুরিকৃত চিকিৎসকের সংখ্যা ১৯১। এর মধ্যে কর্মরত ৭৯ জন। বাকি ১১২টি পদ শূন্য দীর্ঘদিন। নার্সের সংকটও প্রকট। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্টও। বেসরকারি পরিসংখ্যান মতে, ১৮ লক্ষাধিক জনসংখ্যার এ জেলায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষের জন্য মাত্র একজন ডাক্তার রয়েছেন। তবে কর্মরত চিকিৎসকরাও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডিউটি করেন না। তারা বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন নিজেদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল বেশ কয়েক বছর আগে ৫০ শয্যা থেকে একশ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও এখনও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। এরই মাঝে গত বছরের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝিনাইদহ সফরকালে সদর হাসপাতালকে আড়াইশ বেডে উন্নীত করার ঘোষণা দেন। তবে তার কোনো আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

জানা গেছে, সদর হাসপাতালে ২২ জন ডাক্তারের মধ্যে আছেন ১৭ জন। অন্য স্থান থেকে ডেপুটেশনে ডাক্তার এনে কাজ চালানো হচ্ছে। কয়েকজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে সময়মতো অফিসে উপস্থিত না হওয়ার অভিযোগ আছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে দেখেছে, যে সকল ডাক্তার সময়মতো হাসপাতালে হাজির হন না, তারা ওই সময় ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতালে ব্যস্ত থাকেন। এ বিষয়ে একটি রিপোর্টও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়া হয়েছে। তবে অভিযুক্ত ডাক্তাররা এ রিপোর্টকে অসত্য বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. অপূর্ব কুমার সাহা শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড কেয়ার হসপিটল নামে একটি ক্লিনিক খুলে বসেছেন। হাসপাতালে অফিস না করে অধিকাংশ সময় তিনি নিজের মালিকানাধীন ক্লিনিকে বসে থাকেন। সদর হাসপাতালে বসেও ডা. অপূর্ব রোগীদের নিকট থেকে ফি নেন বলে অভিযোগ করেছেন রোগীরা। এ হাসপাতালে প্রতিদিন ৫/৬শ রোগী আউটডোরে চিকিৎসা সেবা পেতে আসেন। বছরে বেডপ্রতি সোয়া লাখ টাকার ওষুধ, গজ-ব্যান্ডেজ ও আনুষাঙ্গিক ব্যয় বরাদ্দ থাকে। কয়েকজন ডাক্তার জানান, হাসপাতালে বর্তমানে ওষুধের কোনো অভাব নেই। তবে রোগীরা জানান, তাদের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। আর দালালের উৎপাত তো আছেই।

এদিকে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করে হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিট স্থাপন করা হয়েছিলো। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে এটি বন্ধ পড়ে আছে। জানা গেছে, জনবলের অভাবে করোনারি ইউনিটের মূল যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে গেছে। ফলে এ জেলার বেশিরভাগ হৃদরোগীকে যশোর কিংবা রাজশাহীতে যেতে হয়। এদের অনেকে পথে যানবাহনেই মারা যান। করোনারি কেয়ার ইউনিটটি চালু থাকলে এসব সংকটাপন্ন রোগীদের জীবন বাঁচানো যেতো বলে স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান।

৫০ শয্যার শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯ জন ডাক্তারের মধ্যে আছেন ৫ জন। প্রতিদিন আউটডোরে আড়াইশ থেকে তিনশ রোগী আসেন। দুজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা সময়মতো হাসপাতালে আসেন না। প্রাইভেট হাসপাতালের দালালরা রোগী ভাগিয়ে নিতে সদা তত্পর এ হাসপাতালে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজা সেকেন্দার স্বীকার করেন, প্রতি মাসে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হলেও মানুষকে তারা কাঙ্খিত সেবা দিতে পারছেন না।

কোটচাঁদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। অবকাঠামো নির্মিত হলেও লোকবল নিয়োগ হয়নি। নতুন কাঠামো অনুযায়ী ২১ জন ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও আছেন ৫ জন। গাইনি কনসালট্যান্টকে ডেপুটেশনে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এনেসথেসিয়ার চিকিৎসক না থাকায় এখানে অনেকদিন থেকে অপারেশন বন্ধ। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, এখানে রোগীর অনেক চাপ। জোড়াতালি দিয়ে হাসপাতাল চলছে।

কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও বেহাল দশা চলছে। ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও ডাক্তার ও অন্য লোকবল নিয়োগ হয়নি। ৩২ জন ডাক্তারের পদ আছে। কর্মরত আছেন ১৪ জন। তার মধ্যে দুজন আবার বিদেশে আছেন। অভিযোগ রয়েছে, ডাক্তাররা প্রাইভেট ক্লিনিক নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। হাসপাতালে বসে ভিজিট নেয়ার অভিযোগও আছে কোনো কোনো ডাক্তারের বিরুদ্ধে। এক্সরে, আল্ট্রাসনো ও ইসিজি মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অচল। হাসপাতালের পরিবেশ নোংরা। এখানে অপারেশন হয় না। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আলতাফ হোসেন দাবি করেন, সংকট থাকলেও হাসপাতালে আসা রোগীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হচ্ছে।

হরিণাকুণ্ডু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন বিশেষজ্ঞসহ ৩০টি ডাক্তারের পদ আছে। অথচ ডাক্তার আছেন মাত্র ৫ জন। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রবিউল ইসলাম জানান, সমস্যা থাকলেও রোগীদের ভালোভাবেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও এখনও লোকবল নিয়োগ হয়নি। ২১ জন ডাক্তারের পদ থাকলেও আছেন মাত্র ৪ জন। রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের সেবার মান মোটেই সন্তোষজনক নয়। বেশিরভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। দালালের খপ্পরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোর এই চিত্র প্রসঙ্গে ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বলেন, তিনি এখানে নতুন এসেছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তাররা যাতে সময়মত অফিস করেন তা তিনি নিশ্চিত করবেন। জেলার স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে সচেষ্ট থাকবেন বলেও তিনি জানান।