জৌলুস হারিয়েছে সাধকদের তীর্থস্থান ফরিদপুরের গোলবাগান

আলমডঙ্গার মরমী সুফি রায়হান গাজীর নাম ভুলতে বসেছে বর্তমান প্রজন্ম

 

রহমান মুকুল: রায়হান উদ্দীন গাজী। কালের আবর্তে আজ এ মহান মরমী সাধকের নাম সকলেই ভুলতে বসেছে। এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে তার অবদান সর্বাধিক। ধারণা করা হয় এ অঞ্চলে তিনিই প্রথম মরমী সুফিবাদের প্রবর্তক। তবে রণগাজী বিশ্বাস নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। তার আসল নাম ঢাকা পড়ে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে। আলমডাঙ্গার ফরিদপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে তিনি মরমী সুফিবাদ প্রচার করতেন। তার স্মারক হয়ে আছে সেখানকার গোলবাগান।

বাংলায় সুলতানী শাসনামল ১৪৪২ থেকে ৪৯ খ্রিস্টাব্দ দিল্লীর সুলতান  যখন নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ। বাংলার বৃহত্তর এলাকা জুড়ে রাজা গৌর গোবিন্দের তখন প্রবল প্রতাপ। তার নিরীহ প্রজা নিপীড়ন, মুসলিম নিধনের নানা কাহিনী দিল্লীর সুলতানের কর্ণগোচর হয়। এরই এক পর্যায়ে অত্যাচারী রাজার কবল থেকে নিরীহ প্রজাদের রক্ষার জন্য সুলতান তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও চৌকষ সেনানায়ক খাঁন জাহান আলীকে কিছু তরুণ সৈন্যসহ পাঠান। রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে খান জাহান আলী আর দরবারে ফেরেননি বলেই ধারণা করা হয়। তিনি সুন্দরবনের পাদদেশে ধর্ম প্রচারের জন্য থেকে যান। যুদ্ধ শেষে ফেরার পথে খাঁন জাহান আলী তার সবচেয়ে অনুগত সহচর সৈনিকদের বিভিন্ন এলাকায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে রেখে যান। মেহেরপুরের পীর মেহেরুল্লা, শেখ ফরিদ, চারুলিয়ার চার পীর, আলমডাঙ্গা ফরিদপুর গ্রামের রায়হান উদ্দীন গাজীকে মানবতার ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব দেন। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে তরুণ ধর্ম প্রচারক রায়হান উদ্দীন গাজী ফরিদপুর গ্রামে শুরু করেন ইসলাম প্রচার। ইসলামের কঠোর শরিয়তপন্থি খাঁন জাহান আলীর সুযোগ্য শিষ্য রায়হান উদ্দীন গাজী ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে ইসলাম ধর্মের আলো জ্বালাতে নিরলস পরিশ্রম করেন। অথচ কঠোর পরিশ্রমেও মানুষের মাঝে সাড়া জাগাতে পারছিলেন না তিনি। এ অঞ্চলের মানুষ গান-বাজনা নিয়েই মেতে থাকতে পছন্দ করতো। তিনি অনুধাবন করছিলেন এ অঞ্চলের প্রকৃতি ও আবহাওয়া মানুষকে ঘরছাড়া উদাস বাউণ্ডুলে জীবনযাপন করতে প্রলুব্ধ করে। এ সকল আত্মভোলা মানুষকে তিনি, শরিয়তের সুকঠিন অনুশাসনের নিগড়ে শত চেষ্টায়ও বাঁধতে পারেননি। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। তিনি ইসলাম প্রচারের সুমহান স্বপ্ন বুকের গভীরে লালন করে সাধারণ মানুষের সাথে আরো বেশি একাত্ম হয়ে গেলেন। যুদ্ধবিজয়ী গাজী সৈনিক হিসেবে বহু অর্থ ছিলো তার। মানুষের বিপদ আপদে অকাতরে অর্থ বিলাতেন। তিনি বুঝতে পারেন শরিয়তের সুকঠিন বাঁধনে এদের বাঁধা যাবে না। ফলে সরে আসেন তিনি শরিয়তের কঠিন অনুশাসন থেকে। কৌশল পরিবর্তন করেন ধর্ম প্রচারের। গান বাজনার আয়োজন করে তিনি গ্রামবাসীকে সেখানে আমন্ত্রণ জানাতেন। এলাকাবাসীকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা দিতেন। অল্প কয়েক বছরেই তিনি ব্যাপকভাবে সফল হলেন। তার নিকট থেকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা নিতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো। জীবদ্দশায় তিনি ধর্মীয় চেতনায় আলোকিত করেন গোটা এলাকা। হয়ে ওঠেন জীবন্ত কিংবদন্তি। মধ্য যৌবনে তিনি ধর্ম প্রচারস্থলে গড়ে তোলেন মনোরম বাগান। যা গোলবাগান নামে  আজ সমধিক খ্যাত। এখানে তিনি নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন তাল, তেঁতুল, বকুল, কুলগাছসহ নানাবিধ বৃক্ষ। তার নিজ হাতে রোপণকৃত কিছু তালগাছ, তেঁতুলগাছ কালের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে প্রায় ৫শ বছরের অধিক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গোড়ামি আর অধর্মের নিকষ অন্ধকার থেকে মানুষকে মানবতার আলোয় আলোকিত করেন। লৌকিক কাহিনি মতে ১৫৫০ সালের দিকে তিনি ভক্ত পরিবেষ্টিত অবস্থায় অন্তর্ধান করেন। অন্তর্ধানসহ তার সম্পর্কে বহু মিথ এলাকায় প্রচলিত।

ধারণা করা হয়, এ বৃহত্তর অঞ্চলে তিনি প্রথম মরমী সুফিবাদ বা ভাববাদের  প্রবর্তক। তার মৃত্যুর পর শ শ বছর এ ফরিদপুর গ্রাম মরমী সাধকের পীঠস্থান হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। এখানে মানবতা ধর্মের যে আলোশিখা তিনি জ্বালিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তা বৃহত্তর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। লালন শাহসহ বহু মরমী সাধক তার মৃত্যুর পরও ফরিদপুর গোলবাড়ি এসেছিলেন বলে কথিত আছে। পরবর্তীতে বেহাল শাহ, শুকলাল শাহসহ অনেক মরমী সাধক ফরিদপুর গ্রামকে তীর্থস্থান ভেবে এখানেই সাধন ভজন করে জীবন কাটিয়েছেন। এ গ্রামকে ৭শ ফকির মরমী সাধকের গ্রাম বলা হয়। আজও তার একটা ক্ষীণধারা বহমান।

এ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম প্রায় কিছুই জানে না। তার প্রকৃত নামটাই ভুলে গেছে প্রায়। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য এখন “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ” হিসেবে গণ্য হয়েছে। অথচ লালন পূর্বসূরী এ মহান মরমী সুফিবাদের প্রবর্তক সম্পর্কে কেউ তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এটা  যতোটা দুঃখজনক, ততোটাই আত্মঘাতী।