জেলা পরিষদ শাসনে অনির্বাচিতরাই

স্টাফ রিপোর্টার: স্থানীয় সরকারের অন্যতম স্তর জেলা পরিষদে ৪২ বছরেও নির্বাচন হয়নি। সংবিধান ও আইনে স্থানীয় সরকারের সকল স্তর জনপ্রতিনিধির দ্বারা পরিচালিত হওয়ার বিধান থাকলেও এসব বিধি বিধান এক্ষেত্রে অকার্যকর রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। এখন এসব জেলা পরিষদে অনির্দিষ্টকালের শাসন চলছে অনির্বাচিত দলীয় ব্যক্তিদের।

সংশ্লিষ্টদের অভিমত, তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে বেসিক ডেমোক্রেসির মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে গঠিত জেলা বোর্ডও গঠন করা হতো নির্ধারিত মেয়াদের জন্য। মেয়াদ শেষে আবার নতুন বোর্ড দায়িত্ব গ্রহণের বিধান কার্যকর ছিলো।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন ও কার্যকর করা হয়। এই সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে, ইতিমধ্যে আইনের দ্বারা ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদকে প্রশাসনিক ইউনিট ঘোষণা করাও হয়েছে। পৌরসভা/ সিটি করপোরেশনও এর অন্তর্ভুক্ত।

নির্বাচনের বিধান রেখে প্রতিটি ইউনিটের জন্য আলাদা আলাদা আইনও করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও হচ্ছে। কিন্তু জেলা পরিষদ নিয়ে বিভিন্ন সরকারের সময়ে টালবাহানা চলে আসছে। স্বাধীনতার পর প্রথম ১৯৮৮ সালে জেলা পরিষদগুলোতে সংসদ সদস্যদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৯০ সালে তত্কালীন এরশাদ সরকারের অবসান হলে ১৯৯১ সালে জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান নিয়োগেরও অবসান ঘটনো হয়। সে সময়ে বিএনপি সরকার জেলা পরিষদের সাথে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনও বাতিল করে। পাশাপাশি উপজেলা পরিষদ বিলুপ্ত করে। তখন থেকে উপজেলা আবার থানা হিসাবে পরিগণিত হয়।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ১৯৯৮ সালে উপজেলা পরিষদ আইন করেও তা বাস্তবায়ন করেনি। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার উপজেলা পরিষদ আইনে পরিবর্তন এনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। এ সরকারের সময়ে পৌরসভা/সিটি করপোরেশন, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদেও নির্বাচন হয়। কিন্তু জেলা পরিষদের বিষয়ে এ সরকারও থাকে উদাসীন।

প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ ২০০০ সালে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন সংশোধন করে। শর্তসাপেক্ষে পরোক্ষ নির্বাচনের বিধানও রাখা হয় এই সংশোধিত আইনে। স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনের ১৯ ধারায় চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচনের বিষয়ে বলা হয়েছে, পরিষদ প্রথমবার গঠনের ক্ষেত্রে সরকার, গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা যে তারিখ নির্ধারণ করবে সে তারিখ থেকে পরিষদ গঠিত হয়েছে বলে গণ্য হবে। এছাড়া আইনে নির্বাচনের জন্য আলাদা বিধি করার বিধানও রাখা হয়েছে। যদিও কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই নির্বাচনের জন্য বিধান বা প্রথমবার পরিষদের গঠন বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করেনি। আইনে একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জেলা পরিষদ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এরমধ্যে ১৫ জন সদস্য ও পাঁচজন সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্যও রাখার বিধান রয়েছে। পরিষদের মেয়াদ পাঁচ বছরকাল বলে আইনে বলা হয়েছে। কিন্তু এখন যেখানে নির্বাচনই নেই সেখানে মেয়াদের প্রসঙ্গও অবান্তর বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। জেলার অধিক্ষেত্রের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বর, পৌরসভা/ সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, উপজেলার চেয়ারম্যান, সদস্য, নারী সদস্য সকলের ভোটে একজন চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান রয়েছে বিদ্যমান আইনে।

২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ ২০১২ সালের ১৫ অক্টোবর দেশের ৬১ জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। এসব প্রশাসকের সকলেই আওয়ামী লীগ দলের স্থানীয় নেতা। যাদেরকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া যায়নি। প্রশাসক নিয়োগের পর নির্বাচন নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে একাধিকবার অনানুষ্ঠনিক আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নির্বাচনের পক্ষেও মত দিয়েছেন। কিন্তু সামপ্রতিককালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এক মন্তব্যে সবকিছু থেমে গেছে। তিনি বলেছেন, স্থানীয় সরকারের স্তর কমিয়ে ফেলা উচিত। এমনকি জেলা পরিষদ না রাখার পক্ষেও জোরালো মতো দেন এই নেতা। ফলে বর্তমান প্রশাসকদের অনির্দিষ্টকালের নিয়োগ বিপরীত চিন্তার উদ্ভব না হওয়া পর্যন্ত বোধহয় চলতেই থাকবে।