জেএমবির বড় হুজুর কাশেম গ্রেফতার

দিনাজপুরের মাদ্রাসা থেকে পালিয়েছেন দেড় বছর আগে

 

হলি আর্টিজানে হামলার অনুমোদন দেন তিনি!

স্টাফ রিপোর্টার: নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আধ্যাত্মিক গুরু শায়খ মাওলানা আবুল কাশেমকে (৬০) গ্রেফতার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম ইউনিট। গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে রাজধানীর মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। ওই সময় তিনি বিকাশের মাধ্যমে টাকা আনতে যাচ্ছিলেন।

পুলিশ দাবি করেছে, আবুল কাশেম জেএমবিতে ‘বড় হুজুর’ নামে পরিচিত। নব্য জেএমবির তামিম আহমেদ চৌধুরী, রাজীব গান্ধী, মারজান, সোহেল মাহফুজ, তানভীর কাদরীসহ অনেকের সঙ্গেই তার সাক্ষাত ঘটেছিলো। ২০১৩ সালে রাজশাহীতে জেএমবির এক শীর্ষ বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সম্প্রতি টাঙ্গাইল থেকে গ্রেফতার রাজীব গান্ধীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হলি আর্টিজানে হামলা­­র অনুমোদন ‘বড় হুজুর’ দিয়েছিলেন। তবে ওই হামলায় তার সম্পৃক্ততা কতটুকু তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হলি আর্টিজান হামলা মামলার চার্জশিট চলতি বছরের শেষের দিকে দেয়া হতে পারে বলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান  মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন।

এর আগে ২০০০ সালে জেএমবির আত্মপ্রকাশের পর ২০০৪ সালের ৩ মে রাজশাহীর বাগমারায় জেএমবির আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন শায়খ আব্দুর রহমান। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ শায়খ রহমানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর জেএমবির মূল দায়িত্বে চলে আসেন হবিগঞ্জ জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা সাইদুর রহমান। ২০১০ সালের ২৫ মে ঢাকার কদমতলী থেকে সাইদুর রহমান, তার স্ত্রী আয়েশা আক্তার ও ছেলে আবু তালহা ফাহিম গ্রেফতারের পর জেএমবির নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। তখন দলের দ্বন্দ্ব নিরসনে সায়েফ নামে এক বিদেশি নাগরিকের মধ্যস্থতা করেন। সায়েফ ছিলেন আল-কায়দার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের একজন দেখভালকারী প্রতিনিধি। এ নিয়ে জেএমবি দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক গ্রুপে নেতৃত্ব দেয় সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা সোহেল। অপর গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে সিদ্দিক। সিদ্দিকের গ্রুপের সামরিক শাখার কমান্ডার নিযুক্ত হন ভাগিনা শহীদ। সোহেল মাহফুজের গ্রুপ থেকে অভিযোগ আসে যে ভাগিনা শহীদ জেএমবি’র আর্থিক তহবিল তছরুফ করেছে। ভাগিনা শহীদের বিশ্বস্ত মিনহাজকে দিয়ে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে মাওলানা সাইদুর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী নূরুন্নাহার হিমুর বড় ভাই মোস্তাকিমকে হত্যা করা হয়। মোস্তাকিম দলের তথ্য পুলিশ ও ব্যাবের কাছে ফাঁস করেছিলো বলে তাকে হত্যা করা হয়। পরবর্তী সময়ে সিদ্দিক ব্যাবের হাতে গ্রেফতার হলে জেএমবি’র মূল নেতৃত্ব চলে আসে সোহেল মাহফুজের হাতে। ওই সময় কারাবন্দী সালাউদ্দিন, রাকিব ও বোমারু মিজানের সাথে সোহেল মাহফুজের যোগাযোগ হতো। সোহেল মাহফুজের নেতৃত্বে নব্য জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডার নিযুক্ত হন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধী গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে মাওলানা আবুল কাশেমের নাম চলে আসে।

গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ২০১৩ সালে তামিম চৌধুরী ও মাওলানা আবুল কাশেমের যৌথ প্রয়াসে বাংলাদেশে নব্য-জেএমবির জঙ্গি তত্পরতার সূচনা হয়। ৫২ বছর বয়সী কাশেমই নব্য জেএমবির ‘আধ্যাত্মিক গুরু’। সংগঠনে তাকে ডাকা হয় ‘বড় হুজুর’ হিসেবে। এই জঙ্গি নেতা এক সময় দিনাজপুরের রানীরবন্দর এলাকার একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। অনেক আগে থেকেই তিনি ‘সপরিবারে’ পুরাতন জেএমবির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

মনিরুল বলেন, ২০০৯ সালে জেএমবির একাংশের আমির মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর কাশেমই সংগঠনের ওই অংশের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১৩ সালে তামিম চৌধুরী ও মাওলানা আবুল কাশেমের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে নব্য জেএমবির কর্মকাণ্ড শুরু হয়।

তামিম চৌধুরী ২০১৩ সালে কানাডা থেকে আসার পর রাজশাহীতে বৈঠক করেন। সেখানে কাশেমও উপস্থিত ছিলেন। তামিম চৌধুরী, মারজানসহ নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই কাশেমের ভক্ত ছিলেন।

মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, গুলশান হামলার ‘অন্যতম পরিকল্পনাকারী’ জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে চলতি বছর জানুয়ারিতে গ্রেফতারের পর কাশেম সম্পর্কে ‘বিস্তারিত তথ্য’ পাওয়া যায়। তবে জাহাঙ্গীরের দেয়া ঠিকানায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।

তিনি জানান, নব্য জেএমবির এই নেতার আরেক নাম শায়খ আবু মোহাম্মদ আইমান হাফিজুল্লাহ। তার বাবা মৃত শওকত আলী। বাড়ি কুড়িগ্রামের চিলমারী থানার জোড়গাছবাজার ইউনিয়নের দাখিয়ারচর গ্রামে। তিনি বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষকতা করার পর দিনাজপুরের রানীরবন্দরের একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বছর দেড়েক আগে সেখান থেকে পালিয়ে যান। তার নামে-বেনামে ‘দাওলার আসল রূপ’, ‘জিহাদ কেন করবেন’, ‘ইসলামি বসন্ত’ এ রকম অনেক জঙ্গিবাদি বই রয়েছে। ‘আধ্যাত্মিক গুরু’ হিসেবে কাশেমই গুলশান হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

কল্যাণপুরের জাহাজবাড়িতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলা গ্রেফতার দেখিয়ে গতকাল দুপুরে কাশেমকে ঢাকার হাকিম সত্যপদ সিকদারের আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম দশ দিনের হেফাজতে নিয়ে কাশেমকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চান। রিমান্ডের শুনানিতে আদালতে আবুল কাশেম বলেন, তাকে গত বছরের ২০ মে ঢাকার ডিবি পুলিশ আটক করে। এতদিন তাকে ডিবি অফিসে আটকে রাখা হয়েছিল। শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।