জিরো থেকে হিরো তিনি ॥ তাকে অনুকরণে এলাকায় সবজি চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে

সবজি চাষের যাদুকর মেহেরপুর হিজুলী গ্রামের রফিকুল

মহাসিন আলী: কৃষিতে সফলতা পেয়ে ভাগ্য ফিরিয়েছেন দিনমজুর কৃষক রফিকুল ইসলাম। সবজি চাষের লাভ থেকে দু’তলা বাড়ি করেছেন, দু’ছেলে-মেয়েকে কলেজ-ভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন। কিনেছেন চাষের জমি, সাথে জমি লিজও নিয়েছেন। ফসল উৎপাদনের যাদুকর রফিকুল ইসলাম মেহেপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের হিজুলী গ্রামের মৃত আজগর আলীর ছেলে। ৬ ভাইয়ের মধ্যে ছোট রফিকুল ইসলাম। দু’যুগ আগে পিতার সংসার ছেড়ে বের হলেও নিজেস্ব জমি-জায়গা ছিলো না তার। বেকারত্ব দূর করতে বেছে নেন পিতার পেশা। ১৯৯০ সালের পরে তিনি পার্শ্ববর্তী ভিটের মাঠে মাত্র ৭ কাঠা জমি ৩শ’ টাকায় লিজ নিয়ে লাল শাক চাষ করেন। ওই জমির উৎপাদিত লাল শাক বাজারে এক হাজার ৬শ’ টাকায় বিক্রি করেন। কয়েক বছর সবজি চাষ করে তিনি ওই ৭ কাঠা জমি ৯ হাজার টাকায় নিজেই কিনে নেন।
সরেজমিনে হিজুলী গ্রামের ভিটের মাঠে গিয়ে দেখা যায় নিজ সবজি ক্ষেত পরিচর্যা করছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, লাল শাক দিয়ে তিনি চাষাবাদ শুরু করলেও তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রায় সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে গোল আলু, পুঁই শাক, লাল শাক, কলা, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধা কপি চাষ করে থাকেন। মসলা হিসেবে তিনি পেঁয়াজ-রসুন, কাঁচা ঝাল ইত্যাদির চাষও করেন। তিনি অল্প কিছু জমিতে ধান, পাট ও গম চাষ করে থাকেন। এমনকি তিনি কলমি শাক, লাল শাকসহ বিভিন্ন ফসলের বীজও তৈরি করে থাকেন। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় জমি লিজ নিয়ে সবজি, মসলা ও সবজি বীজ উৎপাদন করে তা থেকে প্রাপ্ত লাভ দিয়ে ৪ বিঘা জমি কিনেছেন। আর লিজ নিয়েছেন সাড়ে ৩ বিঘা জমি।
দীর্ঘ দু’যুগের সবজি চাষ তাকে সবজির যাদুকর বানিয়েছেন। কোন চাষের পরে কোন সবজি চাষ করতে হবে। কখন কোন সবজির চাষ করলে জমিতে বছরে সবচেয়ে বেশিবার চাষ করা যাবে। কিভাবে চাষ করলে সবজি ফসলে কম পরিমাণ সার-বিষ লাগবে। ফসল হবে বিষমুক্ত। মাঠের অনেক সবজি চাষি এমন তথ্য দিয়ে আরও বললেন, আমরা সবজি, সবজি বীজ ও ফসল চাষে সবসময় তার সহযোগিতা পাই।
রফিকুল ইসলাম জানালেন, চলতি মরসুমে তার ২ বিঘা জমিতে আলু, এক বিঘা জমিতে পুঁই শাক, দেড় বিঘা জমিতে বেগুন, ২ বিঘা জমিতে লাল শাক ও দশ কাঠা জমিতে কলার আবাদ রয়েছে। তিনি পশু-পাখির অত্যাচার থেকে বেগুন ফসল রক্ষা করতে তার জমি নেট দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন। তিনি বললেন, এভাবে বেগুন চাষে একদিকে সার-বিষ কম লাগবে। অন্যদিকে পশু-পাখির অত্যাচার কম হবে। আবার বাজারে বিষমুক্ত বেগুনের চাহিদা বেশি থাকবে। তিনি বললেন, এক বিঘা বেগুন চাষে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এক বিঘা জমির বেগুন ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা সম্ভব হবে। তিনি বললেন, অল্পদিনের মধ্যে তিনি কলমি বীজ কাটবেন। বাড়িতে দাম দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির লোকেরা তার কলমি বীজ কিনে নিয়ে যাবে। লাল শাক দিয়ে তার সবজি চাষ শুরু। তাই প্রতি বছর তিনি তার জমির কিছু অংশে লাল শাক চাষ করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবছর তিনি ২ বিঘা জমিতে অগ্রিম লাল শাকের চাষ করেছেন। ২০ থেকে ২৫ দিন পরে তিনি লাল শাক বাজার জাত করা শুরু করবেন।
সবজি কিংবা সবজি বীজ তৈরিতে লাভ কেমন জিজ্ঞাসা করতেই তিনি জানালেন, আমার জমি ছিলো না। বসতঘর ছিলো না। সবজি চাষের লাভ দিয়ে তিনি দু’তলা বাড়ি করেছেন। মাঠে ৪ বিঘা জমি কিনেছেন। আরও সাড়ে ৩ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন। তার পরে একমাত্র ছেলে সাইফুল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে পাস করে বিসিএস পরীক্ষা অংশ নিচ্ছে। এছাড়া মেয়ে প্যারা মেডিকেল পাস করে ঢাকাতে বিএসসি ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। তিনি বলেন, ঢাকাতে দু’ছেলে-মেয়ের শিক্ষার পিছনে কি খরচ বলেন? তারপরও ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চালিয়ে ২০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে দু’তলা বাড়ি করেছি। এছাড়া ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করে ৪ বিঘা জমি কিনেছি ও সাড়ে ৩ বিঘা জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করছি। মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল আলম জানান, রফিকুল ইসলাম একজন সফল চাষি। তিনি চাষ বোঝেন ও পাশাপাশি কৃষকদের চাষাবাদে নানা প্রকার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একেএম কামরুজ্জামান বলেন, এলাকার সবজি ও সবজি বীজ চাষের যাদুকর কৃষক রফিকুল ইসলাম। তার সফলতা দেখে এলাকার অনেকে লাভজনক চাষ সবজি ও সবজি বীজ উৎপাদনে অগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে ভিটের মাঠ মেহেরপুর জেলায় একটি সবজি উৎপাদন এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।