চুয়াডাঙ্গায় পানিতে ডুবে একমাসে ১১ শিশুর মৃত্যু!

অভিভাবকদের অসাবধানতা ও শিশুদের সাঁতার না জানা এর প্রধান কারণ

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় সেপ্টেম্বর মাসে পানিতে ডুবে ১১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব দুর্ঘটনা ঘটে। যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এ নিয়ে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ২১ শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো। অভিভাবকদের অসাবধানতা ও শিশুদের সাঁতার না জানা এর প্রধান কারণ। বিশেষ করে শেষ মুহূর্তের বর্ষায় যেখানে- সেখানে পানি জমে থাকায় শিশুরা চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

৪ সেপ্টেম্বর পৃথক দুটি ঘটনায় দু শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। তারা হচ্ছে- দামুড়হুদা ব্র্যাক মোড়ের মন্টু মিয়ার ছেলে রাজ হোসেন (৪) ও পোতারপাড়ার আবু সাঈদের ছেলে নাঈম হোসেন (৪)। ৬ সেপ্টেম্বরও আরও দু শিশুর মৃত্যু হয়। এদিন সদর উপজেলার সরিষাডাঙ্গার মহসীন আলীর ১৪ মাস বয়সী মেয়ে মহিমা খাতুন ও আলমডাঙ্গার মিঠু মিয়ার ১৮ মাস বয়সী ছেলে জুবায়ের হোসেন মারা যায়। ৮ সেপ্টেম্বর আলমডাঙ্গার তালুককররার স্বপন আলীর মেয়ে আইভি রহমান (২), ১১ সেপ্টেম্বর জীবননগরের মোক্তারপুরের হাফিজুল ইসলামের ছেলে ইমন (৪), ১২ সেপ্টেম্বর আলমডাঙ্গার ভোলারদাড়ির আনারুল ইসলামের ছেলে রাজু (২) এবং সর্বশেষ ১৭ সেপ্টেম্বর আরও দু শিশুর পানিতে ডুবে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এরা হচ্ছে সদর উপজেলার গাড়াবাড়িয়ার জালাল উদ্দিনের মেয়ে শ্যামলী (৯) ও মাখালডাঙ্গার শের আলীর ছেলে রনি আহমেদ (১২)।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দু সপ্তায় বাড়ির উঠোনে নলকুপের জমে থাকা পানিতে এক এবং পুকুরে ও বাড়ির পাশের ডোবা বা গর্তের পানিতে ডুবে আরও আটজন মারা গেছে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়া সবকটি ঘটনায় ঘটেছে পরিবারের সদস্যদের অসাবধানতার কারণে। নিহতদের মধ্যে সাতজনেরই বয়স পাঁচ বছরের নিচে। বাকিদের বয়স একজনের ৯ ও অন্যজনের ১২ বছর। পানিতে ডুবে এসব মৃত্যুর ঘটনা বেশির ভাগই ঘটেছে সকাল নয়টা থেকে দুপুর দুটোর মধ্যে। এ সময়ে বাবা কর্মস্থলে এবং মায়েরা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। ছেলেমেয়েদের খোঁজ রাখা সম্ভব হয় না। এ কারণে পাঁচ বছর বয়সের নিচের শিশুরাই পানিতে ডুবে মারা যায়। একদিকে তারা যেমন সাঁতার জানেনা, অন্যদিকে পানিতে পড়ে গেলে শরীরকে সামলানোর মতোও ক্ষমতা নেই তাদের।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও অভিভাবকদের সাথে আলাপ এবং ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে জেলায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। তবে চলতি বছরে এ ঘটনা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে পাঁচ ও ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ সময় বর্ষার কারণে বিশেষ করে বর্ষার পানিতে জলকেলিতে মেতে ওঠা বা দাপাদাপি এর অন্যতম কারণ। যে কারণে, পানির উৎস বাড়ির কাছাকাছি যতো, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি ততো বেশি।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, সাঁতার না-জানা পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ। পানিতে ডুবে যাওয়ার পর শরীরকে তারা ভাসিয়ে রাখতে যেমন পারে না, তেমনি বড় মানুষের মতো বেশিক্ষণ শ্বাস নিয়ে বাঁচতে পারে না। ভয়ে-আতঙ্কে হাত-পা ছুটায়, বাঁচানোর জন্য কাউকে ডাকার চেষ্টা করে। সে সময় শ্বাসনালীতে পানি ঢুকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শিশুটি মারা যায়। তবে বেশ কিছু বিষয় জানা থাকলে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার হওয়া শিশুদের বাঁচানো সম্ভব।

চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) রফিকুল ইসলাম বলেন, পানিতে ডুবে যাওয়া শিশুকে অনেক সময় উদ্ধার করা হলেও শুধুমাত্র অজ্ঞতার কারণে বাঁচানো যায়না। এজন্য ডুবে যাওয়া শিশুকে দ্রুত উদ্ধার ও শুকনা স্থানে নিয়ে আসতে হবে। ভেজা কাপড় দ্রুত খুলে গরম কাপড় দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে দিতে হবে। কাত করে শুইয়ে দিয়ে পিঠে আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করতে হবে। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক না হলে এবং নাড়ির গতি ঠিক না থাকলে শিশুর নাক মুখ পরিষ্কার করে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দিতে হবে। যদি সে বমি করতে চায়, তাহলে বমি করার সুযোগ করে দিতে হবে। বমি করানোর সময় তাকে কাত করে ধরতে হবে। এতে ভেতরের পানি বেরিয়ে যাবে। ডুবে যাওয়া শিশুরা ভয়ে-আতঙ্কে অনেক সময় মারা যায়। এজন্য শিশুকে উদ্ধারের পর অভয় দিতে হবে। এরপর যতোদ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। পানিতে শিশু ডুবে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে কিছু না জেনে নিজে নিজে কিছু না করায় ভালো।

সীমান্ত সুইমিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মানিক আকবর বলেন, সারাদেশে জেলা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে সাঁতার শেখা ও নিয়মিত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলেও চুয়াডাঙ্গায় দীর্ঘদিন ধরেই তা বন্ধ। আবার বেসরকারি উদ্যোগে কোনোরকম চালু থাকলেও অভিভাবকদের সেদিকেও সেরকম আগ্রহ নেই।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম লাড্ডু বলেন, জেলায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো সুইমিং পুল নেই। সাঁতার কাটার মতো কোনো জলাশয় বা পুকুরও নেই। দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুরের দীঘিতে মাঝেমধ্যে সাঁতার প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেভাবে সাড়া মেলেনি। তবে নবনির্মিত জেলা স্টেডিয়ামের পাশে সুইমিং পুল তৈরির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।