চুয়াডাঙ্গায় জাতীয় রাজনীতিক সাবেক এমপি মোহাম্মদ শাহজাহানের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

স্টাফ রিপোর্টার: মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত জাতীয় রাজনীতিক মোহাম্মদ শাহজাহানের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। গতকাল ২৪ অক্টোবর ছিলো তার ২৫তম মৃত্যু বার্ষিকী। এ উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গা শহীদ আবুল কাশেম সড়কের মোহাম্মদ শাহজাহান চত্বরে দোয়া মাহফিল ও কোরআনখানি অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া আগামী ২৮ অক্টোবর স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে মোহাম্মদ শাহজাহানের মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে গত রোববার চুয়াডাঙ্গায় সাহিত্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।  এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে মোহাম্মদ শাহজাহান স্মৃতি সংসদ। প্রতিযোগিতায় চারটি বিভাগে শতাধিক শিশু অংশগ্রহণ করে। আগামী ১০ নভেম্বর শুক্রবার বিকেল ৩টায় চুয়াডাঙ্গা জেলা শিল্পকলা একাডেমীর উন্মুক্ত মঞ্চ প্রাঙ্গণে বিজয়ী সকল প্রতিযোগীর মধ্যে পুরস্কার ও সনদপত্র প্রদান করা হবে। এছাড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সকল প্রতিযোগীকে শুভেচ্ছা পুরস্কার দেয়া হবে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সকল প্রতিযোগীকে অভিভাবকের সাথে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অনুষ্ঠানমালায় উপস্থিত থাকবেন মরহুমের সহধর্মিণী, পুত্র-কন্যা, জামাই ও নাতি-নাতনি উপস্থিত থাকবেন।

চুয়াডাঙ্গার কৃতি সন্তান মোহাম্মদ শাহ্জাহান : মোহাম্মদ শাহজাহান চুয়াডাঙ্গা জেলার কৃতি সন্তানদের মধ্যে এক ও অনন্য ব্যক্তি হিসাবে দেশ ও বিদেশে চুয়াডাঙ্গার নাম উজ্জ্বল করেছেন। ১৯৩৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গার জেলার আলমডঙ্গা থানাধীন রংপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। তার পিতার নাম  মো. খোদাদাদ হোসেন, মাতার নাম শুভতারা। তিনি ১০ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। ১৯৫১ সালে চুয়াডাঙ্গা  ভি.জে হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পান করেন এবং ১৯৫৩ সালে যশোর সরকারি এম.এম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৫৬ ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করেন মোহাম্মদ শাহজাহান। ওই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র দুজন ছাত্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন, তাঁদের মধ্যে তিনি একজন। ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে তিনি প্রথমে চুয়াডাঙ্গা ভি.জে স্কুলে অবৈতনিক ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পরে প্রিয় পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন এবং গোকুলখালী হাইস্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। এখানে শিক্ষকতার সাথে সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নেন এবং যথাসময়ে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৫৮ সালে এমএ পাস করেন। এরপরে আলমডাঙ্গা সংলগ্ন গোস্বামী দুর্গাপুর হাইস্কুলে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসাবে ১৯৫৯-৬০ সালে কর্মরত ছিলেন।

মোহাম্মদ শাহজাহান ছিলেন নানামুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি স্কুলের ছাত্রজীবন থেকেই চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। এসব কর্মকাণ্ড সমাধার জন্যে তিনি তার সমবয়সী ও বয়স্ক দায়িত্বশীল উদ্যোগী লোকজনকে সংগঠিত করেন। স্কুলের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন ৫ জন সহপাঠী নিয়ে গঠন করেছিলেন ছাত্র-উন্নয়ন কমিটি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী ছাত্র ও সাধারণ লোকজনকে নিয়ে সাংস্কৃতিক কমিটি, সমাজ-সেবা কমিটি, শ্রমিক উন্নয়ন কমিটি ও রাজনৈতিক কমিটি। সাংস্কৃতিক কমিটিকে তিনি আবৃত্তি, নাটক, বিতর্কচর্চা, সংগীত, খেলাধুলা ইত্যাদি কয়েকটি দলে ভাগ করেন। যারা যে বিষয়ে আগ্রহী তারা সেই বিষয়ে যোগ দিয়ে নিজেদের প্রতিভা বিকাশে সুযোগ পেয়ে নিজেদের মতো করে বিকশিত হয়ে ওঠেন। তরুণ বয়স থেকেই তার সব কাজেই ছিলো দক্ষতা এবং পরিকল্পনার ছাপ। ফলে সব কাজ তিনি সুচারুভাবে সমাধা করতে পারতেন। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন মোহাম্মদ শাহজাহান সাংস্কৃতিকচর্চার সাথে যুক্ত হন এবং ছড়া ও কবিতা লিখতে শুরু করেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত নিয়মিত বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহ করতেন। এভাবেই তিনি ৫০ এর দশকে চুয়াডাঙ্গা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ জায়গা করে নেন। তৎকালীন স্বল্প শিক্ষিত সমাজের মধ্যে থেকে সংস্কৃতিমনা যুবকদের সংগঠিত করে তিনি সর্ব প্রথম চুয়াডাঙ্গা সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে বিকশিত করেন। তিনি ছিলেন অসম্ভব গ্রন্থ-প্রেমী পড়ুয়া, ভালো আবৃত্তিকার, সুবক্তা ও তুখোড় অভিনেতা। শিক্ষকতা জীবনে তার ছাত্রদের এসব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। ১৯১০-১২ সাল থেকে ছোট পরিসরে চুয়াডাঙ্গায় খেলাধুলা, নাটক ও সংগীতচর্চা শুরু হয়েছিলো। পরের দুই দশকে খেলাধুলা, নাটক এবং সংগীতচর্চায় অনেকটা সাফল্য লাভ করে। ১৯২৮ সালে চুয়াডাঙ্গায় ‘শ্রীমন্ত টাউন হল’ নির্মিত হলে এই হলকে কেন্দ্র করে নাটকচর্চার প্রসার ঘটে। এই মঞ্চে প্রখ্যাত অভিনেতা শিশিরকুমার ভাদুড়ী (১৮৮৯-১৯৫৯), অহীন্দ্র চৌধুরী (১৮৯৮-১৯৭৪), বিনোদিনী দাসী (১৮৬৩-১৯৪১) কাননবালা দেবী (১৯১৫-১৯৯২) এবং আরও অনেক বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন। এই মঞ্চে ‘সাজাহান’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘দেবলা দেবী’, ‘কেদার রায়’ ইত্যাদি নাটক সাফল্যের সাথে অভিনীত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে পাকিস্তান আমলে চুয়াডাঙ্গার সাংস্কৃতিক অঙ্গন ঝিমিয়ে পড়ে। সেই ঝিমিয়ে পড়া শ্রীমন্ত টাউন হলকে সর্বসাধারনণর জন্য সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তরুণ মোহাম্মদ শাহজাহানের ভূমিকা ছিলো অগ্রগণ্য। বলিষ্ঠ নাট্যাভিনেতা হিসেবে তিনি ওই সময়ে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য  নাটক ‘অভিযান’, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’ নাটকের নামভূমিকায় অভিনয়ের কথা এখনো সে সময়ের দর্শকদের মুখে শোনা যায়। ওই নাটকে মোহাম্মদ শাহজাহানের বাবা খোদাদাদ হোসেন ভৃত্যের ভূমিকায় অভিনয় করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকেও তিনি সিরাজের ভূমিকায় এবং তার বাবা গোলাম হোসেনের ভূমিকায় করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী আবুল হোসেন মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি ১৯৪৭ সালের পরে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।  সেই সময়ে এই লাইব্রেরি পুনর্গঠনে মোহাম্মদ শাহজাহান অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে এই প্রতিষ্ঠানের অনারারি লাইব্রেরিয়ান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। লাইব্রেরিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে গ্রন্থ-প্রেমিক পড়ুয়া মোহাম্মদ শাহজাহান লাইব্রেরির প্রতি মমত্ববোধ থেকে গোস্বামী দুর্গাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ ছেড়ে দিয়ে ১৯৬১ সালে চুয়াডাঙ্গা ত্যাগ করে ঢাকায় যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি সায়েন্সে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের আশায়। ঢাকাতে অবস্থানকালে তিনি নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে এক সময় ঢাকায় শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। মোহাম্মদ শাহজাহান ছাত্রজীবন থেকেই নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে বেড়ে ওঠেন। ভি.জে স্কুলে ছাত্রাবস্থায় এই এলাকার শোষিত বঞ্চিত মেহনতী মানুষকে সংগঠিত করে তিনি সর্ব প্রথম চুয়াডাঙ্গায় রিকশা শ্রমিক ও রেলস্টেশনের মজুরদের সংগঠিত করে ‘হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়ন’ গঠন করেন। সে সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যে কোনো দুর্নীতি এবং অব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন মোহাম্মদ শাহজাহান।