চাষী নজরুল আর নেই

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের সর্বাধিক সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্রের নির্মাতা দেশবরেণ্য চিত্রপরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম আর নেই। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এ চলচ্চিত্র পরিচালক দীর্ঘদিন লিভার ক্যান্সারে ভোগার পর গতকাল রোববার ভোর ৬টায় রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান (ইন্নালিল্লাহে…রাজেউন)। তার বয়স হয়েছিলো ৭৩ বছর। শিল্পীর মরদেহ প্রথমে মতিঝিলের ইডেন মসজিদ ও এরপর গোপীবাগের ব্রাদার্স ক্লাবে দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাখা হয়েছে ল্যাব এইড হাসপাতালের হিমাগারে।

জানা গেছে, আজ সোমবার সকাল ১০টায় এফডিসিতে আরেকটি জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বায়তুল মোকাররম ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাদ জোহর জানাজার পর মুন্সিগঞ্জে গ্রামে মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে তাকে। চাষী নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এছাড়া স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, চিফ হুইপ আসম ফিরোজসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সংস্কৃতি কর্মীরা শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

চাষী নজরুল ইসলামের প্রয়াণে নায়করাজ রাজ্জাক বলেছেন, আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। ষাটের দশকে ওর আর আমার ক্যারিয়ার একসাথে শুরু হয়েছিলো বলা যায়। ওরা ১১ জন, শুভদা, চন্দ্রনাথ, বাজিমাত ছবিগুলোতে তার পরিচালনায় অভিনয় করেছি। অসুস্থ হওয়ার পর চাষী মাঝে বিদেশে গিয়েছিলো, তখন আমিও অসুস্থ। ও দেশে ফেরার পর ফোনে কথা হতো। ওকে বলেছিলাম, শরীরটা আমারও ভালো না। দোয়া করিস আমার জন্য। এছাড়া প্রায়ই আমার ছেলে সম্রাটকে দিয়ে তার খোঁজখবর নিতাম। ওর চলে যাওয়ায় খুব খারাপ লাগছে আমার। বন্ধুকে হারিয়ে মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে।

চিত্রনায়িকা ববিতা বলেন, আমাদের কাছের মানুষগুলো এভাবে হঠাত চলে যাচ্ছেন, এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। চাষী ভাই আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। কয়েকদিন আগেও তার বাসায় গিয়েছিলাম। তার অসুস্থতা দেখে খুব খারাপ লাগছিলো। তার সাথে অভিনয় বা কাজ হয়েছে বলে নয়, তার মতো পরিচালক পাওয়া সত্যি দুষ্কর। কারণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। ওরা ১১ জন যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছবি, তেমনি এটি একটি ইতিহাস। তিনি অনেক সাহসী পরিচালক ছিলেন। ভালোবাসা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, ভালো মানুষ, মিঞা ভাই, হাসন রাজাসহ তার পরিচালনায় বেশকিছু ছবিতে ও আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে বেশকিছু ছবিতে চাষী ভাইয়ের সাথে কাজ করেছি। তার জন্য মনটা কাঁদছে। চাষী নজরুল ইসলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সফল চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে মুষ্টিমেয় যে কজন চলচ্চিত্র পরিচালক স্থান পেয়েছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ১৯৪১ সালের ২৩ অক্টোবর বিক্রমপুরের শ্রীনগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার নামকরণ করেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। ফতেহ লোহানীর আছিয়া সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসাবে ১৯৬১ সালে চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। এর দু বছর পর তিনি দু দিগন্ত ছবিতে কাজ করেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার ওবায়েদ-উল-হকের সহকারী হিসেবে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনতার জন্য মুক্তিকামী মানুষের সাথে চাষী নজরুল ইসলামও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন মুক্তি পায় এবং এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণেও চাষী নজরুল ইসলাম দারুণ সফল। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস উপন্যাস অবলম্বনে বিভিন্ন ভাষায় মোট ৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও মূল উপন্যাসের সবচাইতে কাছাকাছি চিত্রায়ণ ঘটেছে ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত দেবদাস চলচ্চিত্রে। এছাড়া শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শুভদা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প অবলম্বনে শাস্তি, সুভা, রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে মেঘের পরে মেঘ, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র শিল্পী এবং লোককাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র বেহুলা লখীন্দর তার অমর সৃষ্টি। ৭৩ বছরের জীবনকালে তিনি মোট ২৭টি সিনেমা নির্মাণ করেন। এরমধ্যে শুভদা ও হাঙ্গর নদী গ্রেনেড চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ২০০৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। তার পাওয়া অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বাংলাদেশ সিনে জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড (১৯৭৪), শের-ই-বাংলা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৮), স্যার জগদীর্শচন্দ্র বসু স্বর্ণপদক (১৯৯৫), জহির রায়হান স্বর্ণপদক (১৯৯৫), জহির রায়হান আজীবন সম্মাননা, আন্তর্জাতিক কালাকার পুরস্কার (২০০৫) প্রভৃতি। একজন মুক্তিযোদ্ধা, সফল চলচ্চিত্র পরিচালক এবং সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হিসেবে তার নাম বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চিরদিনই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো হলো- ওরা ১১ জন (১৯৭২), সংগ্রাম (১৯৭৪), ভালো মানুষ (১৯৭৫), বাজিমাত (১৯৭৮), দেবদাস (১৯৮২), চন্দ্রকথা (১৯৮৫), শুভদা (১৯৮৬), লেডি স্মাগলার (১৯৮৬), মিয়া ভাই (১৯৮৭), বেহুলা লক্ষ্মিন্দর (১৯৮৭), বিরহ ব্যথা (১৯৮৮), মহাযুদ্ধ (১৯৮৮), বাসনা (১৯৮৯), দাঙ্গা ফাসাদ (১৯৯০), পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১), দেশ জাতি জিয়া (১৯৯৩), আজকের প্রতিবাদ (১৯৯৫), শিল্পী (১৯৯৫), হাছন রাজা (২০০১), কামালপুরের যুদ্ধ (২০০২), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), শাস্তি (২০০৫), সুভা (২০০৫), ধ্রুবতারা (২০০৬), দু পুরুষ (২০১১), দেবদাস (২০১৩), অন্তরঙ্গ (মুক্তির অপেক্ষায়) এবং ভুল যদি হয় (মুক্তির অপেক্ষায়)।

জেপির শোক: জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি এবং মহাসচিব সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। নেতৃদ্বয় এক বিবৃতিতে বলেন, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো। তারা মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।