চলছে উদ্ধার কাজ বেরিয়ে আসছে লাশ

 

রাঙামাটিতে নিখোঁজ সেনা সদস্য আজিজুরের মরদেহ শনাক্ত

স্টাফ রিপোর্টার: রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে নিখোঁজ সেনা সদস্য আজিজুর রহমানসহ আরও তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। আজিজুর রহমান রাঙামাটির মানিকছড়ি রিজিয়নে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি মাদারীপুর জেলায়। গত মঙ্গলবার মানিকছড়িতে পাহাড় ধসের ঘটনায় উদ্ধার অভিযানে গিয়ে মাটি সরানোর সময় মাটিচাপা পড়ে নিখোঁজ হন সেনাবাহিনীর এই সদস্য। ওইদিন পাহাড় ধসে সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তাসহ চার সেনা সদস্য নিহত হন। এরা হলেন_ মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত, করপোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক ও সৈনিক মো. শাহিন আলম।
টানা প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৫৪ জনে দাঁড়িয়েছে। আরও বহু আহত এবং নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এখন পাহাড়ের মাটিচাপা থেকে একের পর এক লাশ বেরিয়ে আসছে। কেউ মা হারিয়েছেন, কেউ বাবা হারিয়েছেন, কেউ সন্তান হারিয়েছেন আবার কেউবা স্বামী কিংবা স্ত্রী হারিয়েছেন। এতে স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রাঙামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান ১৪২ জন, কক্সবাজার থেকে দুইজন এবং খাগড়াছড়ি থেকে দুইজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সব জায়গায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে পাহাড়ি ঢলে মঙ্গলবার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখানে বর্ষণ অব্যাহত থাকায়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকা থেকে হতাহতের উদ্ধার করতে পারছে না উদ্ধারকর্মীরা। সবমিলে যেন পাহাড়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে গত রোববার থেকেই ভারী বৃষ্টির শুরু হয়। সোমবার রাত থেকে এ অঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ে ধস নামে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা বৃষ্টির মধ্যেই মঙ্গলবার ভোর থেকে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। এদিকে বুধবার দুপুরের দিকে খাগড়াছড়িতে পাহাড় ধসে নিহত দুইজনের খবর আসে। জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম বর্মাছড়ি ইউনিয়নে পাহাড় ধসে এক নারীসহ দুইজনের মৃত্যু হয়।
মঙ্গলবার টানা বর্ষণে বর্মাছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ খবর নিশ্চিত করেছেন। সাবেক লক্ষ্মীছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র চাকমা বলেন, বর্মাছড়ি ইউনিয়নের ফুত্যাছড়া পাড়ার প্রাণকৃত্য চাকমার ছেলে পরিমল চাকমা (৩০) পাহাড় ধসে মাটিচাপায় মারা যান। একই পরিবারের শিশু ও নারীসহ আরও সাতজন আহত হয়। বুধবার সকালে আহতদের লক্ষ্মীছড়ি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। লক্ষ্মীছড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা হলেন_ মধ্যম বর্মাছড়ি পাড়ার সজিব চাকমার স্ত্রী রজমালা চাকমা (২৪), তার নয় বছরের কন্যা পার্কি চাকমা ও ছয় বছরের শিশু তুষি চাকমা।

স্থানীয় সাংবাদিক মোবারক হোসেন জানান, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ঘটনাস্থলে আহত হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন- একই গ্রামের ধনঞ্জয় চাকমা (৬৫), তার স্ত্রী তিতুর বালা চাকমা (৫৫), মেয়ে সাবিত্রী চাকমা (৪০) ও সাবিত্রী চাকমার ছেলে এপিন চাকমা। দুর্গম এলাকা এবং সড়ক যোগাযোগ না থাকায় তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরিবারের একমাত্র সুস্থ থাকা সদস্য সজিব চাকমা বলেন, তিনি এখন নিরুপায়। বাড়ির সবাই পাহাড়ের মাটিচাপা পড়ে আহত হয়েছে। বাকি আরও দুইজন আহত ব্যক্তির নাম জানা যায়নি। রোববার বিকালে ঘটনাটি ঘটলেও দুর্গম এলাকা, দুর্বল নেটওয়ার্ক হওয়ায় সংবাদকর্মীদের খবর পেতে দেরি হয়েছে। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা পাহাড় ধসে একজনের মৃত্যু ও সাতজন আহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে। এছাড়া তিনটি গরুও মারা যায়। তিনি জানান, লক্ষ্মীছড়ি হাসপাতালের চিকিৎসক শেখ মুজিবরের নেতৃত্ব একটি মেডিকেল টিম দুর্গম এলাকা বর্মাছড়িতে আহতদের চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে।

এদিকে বর্মাছড়ি ও কাউখালী সীমান্তে হলুদ্যাপাড়া বড়ইতলী এলাকার পুতুল্যা চাকমার স্ত্রী কালেন্দ্রী চাকমা (৪৫) মাটিচাপায় মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় পতুল্যা চাকমা আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ ইকবাল পাহাড় ধসের ঘটনায় দুইজনের মৃত্যুর খবর শুনেছেন। ঘটনাস্থল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় কারও সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানান। তবে এ ঘটনা কাউখালী উপজেলায় ঘটেছে বলে অপর একটি সূত্রে জানা গেছে। লক্ষ্মীছড়ি থানার অফিসার্স ইনচার্জ আরিফ ইকবাল পাহাড় ধসের ঘটনায় মৃত্যুর খবর শুনেছেন তবে কেউ এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ নিয়ে আসেনি।

দুই সেনা কর্মকর্তার দাফন সম্পন্ন রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিতে গিয়ে নিহত সেনা কর্মকর্তা মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক ও ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্তর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বনানীর সামরিক কবরস্থানে সামরিক মর্যাদায় তাদের মরদেহ সমাহিত করা হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) মেজর জেনারেল মো. নাজিম উদ্দীনসহ মৃতের আত্মীয়-স্বজন ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গত ১৩ জুন রাঙামাটির মানিকছড়িতে অতিবৃষ্টিতে একটি পাহাড়ধসে মাটি ও গাছ পড়ে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। এতে রাঙামাটি জোন সদরের নির্দেশে মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল ওই সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালীন বেলা ১১টার দিকে সংলগ্ন পাহাড়ের একটি বড় অংশ উদ্ধারকারী দলের ওপর ধসে পড়লে তারা মূল সড়ক থেকে ৩০ ফুট নিচে পড়ে যায়। পরে একই ক্যাম্প থেকে অপর একটি উদ্ধারকারী দল পৌঁছে দুই সেনা কর্মকর্তাসহ চার সেনা সদস্যকে নিহত এবং ১০ সেনা সদস্যকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন। পরদিন বেলা ১১টার দিকে হেলিকপ্টারে নিহত সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। নিহতদের মধ্যে মেজর মাহফুজুল হকের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে। তিনি ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে যোগদান করেন এবং ৪৪ বিএমএ লং কোর্সের সাথে কমিশনপ্রাপ্ত হন। তিনি বিবাহিত এবং পাঁচ বছর বয়সী এক ছেলের জনক। ক্যাপ্টেন তানভীরের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। তিনি ২০০৯ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে যোগদান করেন এবং ৬৪ বিএমএ লং কোর্সের সথে কমিশনপ্রাপ্ত হন। মাত্র ১০ মাস আগে বিয়ে করেন তানভীর।