ঘাতক বাস কেড়ে নিল দুই মেধাবী স্কুলছাত্রীর প্রাণ

ষষ্ঠ শ্রেণির খাদিজা বেড়াতে এসেছিল ঢাকায় : নবম শ্রেণির সোনালী কম বেতনের সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে যাচ্ছিলো
স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর শাহবাগে গতকাল পৃথক সময়ে বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় দুই স্কুলছাত্রী নিহত হয়েছে। সকালে মত্স্যভবন এলাকায় নবম শ্রেণির সাবিহা আক্তার সোনালী (১৫) ও বিকেলে শিশু পার্কের সামনে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী খাদিজা সুলতানা মিতু (১২) নিহত হয়। সোনালী সেগুনবাগিচার বেগম রহিমা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। আর খাদিজা কমিল্লার মনোহরগঞ্জের লক্ষ্মণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে (পিইসি) জিপিএ-৫ পেয়েছে। সোনালী নিহত হওয়ার ঘটনায় মত্স্যভবন এলাকায় ঘণ্টাব্যাপী সড়ক অবরোধ করে রাখে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ আশ্বস্ত করলে তারা অবরোধ তুলে নেয়। এ সময় ওই সড়কের যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিলো।
কম বেতনের স্কুলে ভর্তি হতে যাচ্ছিলো সোনালী : প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতের স্বজনরা জানান, গণপূর্ত ভবনের কোয়ার্টারে একটি মেসে সোনালী তার বাবা মায়ের সাথে বসবাস করে। সে বেগম রহিমা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। এ বছর সে তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির চান্স পায়। ওই বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সকালে সে বাসা থেকে বের হয়। সে বার কাউন্সিল সংলগ্ন রাস্তা পার হতে গেলে প্রেসক্লাব থেকে শাহবাগগামী ৮ নম্বর রুটের বেপরোয়া একটি বাস তাকে চাপা দেয়। এতে সে গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। বাসটি দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে যাত্রী এবং পথচারীরা বাসটি আটক করে ভাঙচুর করে। তবে চালক পালিয়ে যায়। পথচারীরা খবর দিলে বাবা সোনালীকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিত্করা জানান, ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই সেগুনবাগিচার রহিমা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দুর্ঘটনাস্থলে এসে সড়ক অবরোধ করে। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকল্প রাস্তায় যান চলাচলের কারণে ওই এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেয় শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভের সময় সোনালীর সহপাঠী ফারজানা আক্তার কবিতা জানায়, সোনালী সব সময় প্রথম স্থানেই ছিলো। ভালো গানও গাইতো, বিভিন্ন সময় কবিতা লিখতো। সবাই সোনালীকে খুব পছন্দ করে।
সোনালীর বাবা জাকির হোসেন রঙের কাজ করে সংসার চালান। মা শারমিন আক্তার কুলসুম বনশ্রী প্রভাতী বাস সার্ভিস অফিসে পিয়নের কাজ করেন। এক ভাই আছেন, তার নাম সাজ্জাদ হোসেন সৈকত। তিনি নরসিংদীর পলিটেকনিক্যাল কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করেন। সোনালীর বাবা বলেন, সোনালী জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস পেয়েছে। আমার আয় কম, তাই আমার মেয়ে আমাকে বলতো, ‘বাবা আমি সরকারি স্কুলে ভর্তি হবো, সেখানে বেতন কম। তোমার ওপর চাপ পড়বে না’। সেকারণেই আজ আমার মেয়ে তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য বাসা থেকে সকালে বের হয়। কিন্তু রাস্তায় ঘাতক বাস আমার মেয়ের প্রাণ কেড়ে নিলো। তিনি আরো বলেন, গণপূর্ত ভবনের কোয়ার্টারে একটি মেসে আমরা ভাড়া থাকি। ঘটনার সময় আমি গোসল করছিলাম। এক লোক দৌড়ে এসে বলে, আপনার মেয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। দ্রুত ছুটে গিয়ে দেখতে পাই, সোনালী রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে।
ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। তিনি জানান, ‘ওই ছাত্রীর মাথার ওপর দিয়ে গাড়ির চাকা যাওয়ার কারণে মাথা থেঁতলে যায় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। শাহবাগ থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানান, পুলিশ বাসটি আটক করেছে।
ঢাকায় বেড়াতে এসেছিল খাদিজা: এদিকে বিকেলে শিশুপার্কের সামনের রাস্তায় বাসের চাপায় খাদিজা সুলতানা মিতু নিহত হয়। খাদিজা কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের মানদুরা গ্রামের বাসিন্দা বাচ্চু মিয়ার মেয়ে। মনোহরগঞ্জের লক্ষ্মণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে (পিইসি) জিপিএ-৫ পেয়েছিলো। সে লক্ষ্মণপুর ফাজিল মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলো। নিহতের স্বজনরা জানান, বালুরমাঠ এলাকায় খাদিজার বড় বোন আয়শার শ্বশুর বাড়ি। গত ১২ জানুয়ারি খাদিজা ওই বাড়িতে বেড়াতে আসে। খাদিজা তার বোন আয়শা ও দুলাভাই ওমর ফারুকের সাথে শিশু পার্কে বেড়াতে আসে। বিকেল ৪টার দিকে তারা শিশু পার্কের গেটের সামনে রাস্তা পার হতে গেলে বাস খাদিজাকে চাপা দেয়। এতে সে গুরুতর আহত হয়। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিত্সক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘাতক বাস ও চালককে আটক করা হয়েছে। খাদিজার দুলাভাই বলেন, ‘আমার বাসা রাজধানীর শ্যামপুরে। ১০-১২ দিন আগে আমি শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাই। আসার সময় খাদিজাকে বেড়াতে ঢাকায় নিয়ে আসি। গতকাল আমরা সপরিবারে শিশু পার্কে আসি। সেখানে ঘোরাঘুরির পর নাস্তা করার জন্য একটি রেস্টুরেন্টের দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তা পার হওয়ার সময় দ্রুতগামী একটি বাস খাদিজাকে চাপা দেয়।’ খাদিজার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে। শাহবাগ থানার ওসি জানান, দুর্ঘটনার পরপরই জনতা ঘাতক বাস ও চালককে আটক করে। জনতা বাসচালককে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে। এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।