গাংনীতে জোরপূর্বক পৌর মার্কেট নির্মাণের অভিযোগ ॥ জমির মালিকানা পেতে সপরিবারে অবস্থান

 

গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুর গাংনী শহরের হাট সংলগ্ন এলাকায় ১৩ শতক জমিতে পৌর মার্কেট নির্মাণকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বিরাজ করছে। স্থানীয় আজিম গং দাবি করছে ওই জমি তাদের সম্পত্তি। এ কারণে মার্কেট নির্মাণে বাঁধা দিচ্ছেন তারা। রোববার সকালে ওই পরিবারের নারী পুরুষ সদস্যরা জায়গার ওপর অবস্থান নিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। জীবন দিয়ে হলেও জমি রক্ষা করা হবে জানিয়ে তারা রাতভর সেখানে অবস্থান করছেন। বাধার মুখে সকাল থেকে কাজ বন্ধ রেখেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, নিয়ম মেনেই নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। রোববার গাংনী উত্তরপাড়ার মৃত আজিম উদ্দীনের সাত ছেলে, তাদের স্ত্রী ও নাতি-নাতনিসহ পরিবারের লোকজন ওই জমিতে গিয়ে নির্মাণ কাজে বাধা দেন। আজিম উদ্দীনের মেজ ছেলে আব্দুল গফুর প্যারাইলডস হয়েও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেখানে অবস্থান নেন। নির্মাণ কাজে বাধা দিলে মেয়েরের লোকজনের সাথে তাদের মৃদু বাগবিত-া বাধে। কিছুক্ষণ পরে পৌর মেয়র আশরাফুল ইসলাম সেখানে গিয়ে নির্মাণ কাজ শুরুর নির্দেশ দেন। এতে আজিম উদ্দীনের পুত্রবধূরা কাজ করতে দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। এ নিয়ে মেয়রের সাথে তাদের কিছুটা বাদানুবাদ হয়। এরই একপর্যায়ে মেয়র ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। তখন থেকে নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। হয় জমি পাবো, না হয় জীবন যাবে। তাদের বুকের ওপর দিয়ে নির্মাণ কাজ করতে হবে। এমন দাবি তুলে তারা সেখানে অবস্থান নিয়েছেন।

গাংনী শহরের প্রাণকেন্দ্রে মাংস বিক্রির স্থানের সামনে হাটের জন্য জেলা পরিষদ কর্র্তৃক দীর্ঘ কয়েক বছর আগে একটি টিনের শেড নির্মাণ করে। যেটি কয়েকটি পিলারের ওপর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি ছিলো। জেলা পরিষদ সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘ কয়েক বছর আগে এটি মেহেরপুর জেলা পরিষদ হাটের জন্য নির্মাণ করেছিলো। তবে জেলা পরিষদ এটি নির্মাণ করলেও গাংনী পৌরসভার আওতাধীন হাটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি দোকান ছিল। সম্প্রতি গাংনী পৌর মেয়র আশরাফুল ইসলাম সেটি ভেঙ্গে মার্কেট নির্মাণের ঘোষণা দেন। এতে বাধা দেন আজিম উদ্দীনের ছেলে-মেয়েরা। তারা সেখানে একই সাইনবোর্ড টানিয়ে আদালতের রায় পেয়েছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু তা তাদের ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন মেয়র। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কয়েকদিন ধরে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছিল।

একপর্যায়ে গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গাংনী পৌর মেয়র তার লোকজন এবং পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে নিয়ে আকস্মিকভাবে সেখানে ঘর নির্মাণ শুরু করেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে দিনরাত এক নাগাড়ে নির্মাণ কাজ চলছিল। এরই মধ্যে সেখানে কয়েকটি ঢালাই পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় বিভিন্ন মহলে ধর্না দিয়ে কোন সুরাহা না হওয়ায় জমিতে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন আজিম উদ্দীনের পরিবারের সদস্যরা। তবে নির্মাণ কাজ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। কখন কিভাবে টেন্ডার হয়েছে এসব বিষয়ে কোন কিছুই জানে না সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। পৌরসভা যদি মার্কেট নির্মান করবে তাহলে দিনরাত কেন পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মেয়রের ব্যক্তিগত লোকজন পাহারা করছে? এতো দ্রুত কেন নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে? তাছাড়া পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত সেখানে পাহারা করেছে। আশেপাশের হোটেলগুলোতে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পৌরসভার রুটিন কাজকর্ম বন্ধ করে কেন তাদের নিয়ে সেখানে পাহারা করা হচ্ছে তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

জমিতে অবস্থান নেয়াকালে মৃত আজিম উদ্দীনের পুত্র হাসানুজ্জামানের স্ত্রী মাহফুজা খাতুন জানান, এখানের স্থাপনা ভাঙ্গার সময় থেকেই মেয়র ও তার লোকজন দিয়ে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। বাধা দিলে গুলি করে হত্যারও হুমকি দিয়েছে তারা। ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ঘিরে রেখে মার্কেট নির্মাণ করছেন মেয়র। কিন্তু আমরা তো গরিব মানুষ। এই জমি ছাড়া আমাদের কিছুই নেই। তাই জীবন গেলেও জমি ছাড়বো না। জমির মালিকানা বিষয়ে পৌর মেয়র আশরাফুল ইসলাম দাবি করেছেন, তারা ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে জমির মালিকানা দাবি করছে। মূলত জমির মালিক সরকার। একশ-দেড়শ বছর ধরে সরকারের দখলে সেখানে হাট বসে। তাই নিয়মানুযায়ী পৌর মার্কেটের উন্নয়ন করা হচ্ছে। তারা যদি জমির রেকর্ড, খাজনা-খারিজ দেখাতে পারে তাহলে জমি ছেড়ে দেয়া হবে। আদালত থেকে তো কোন নিষেধাজ্ঞা নেই যে, সেখানে কোন নির্মাণ কাজ করা যাবে না। তাহলে কিসের বলে তারা সেখানে অবস্থান নিচ্ছে। মেয়ে মানুষ সেখানে বসিয়ে বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে তারা।

এদিকে মার্কেট নির্মাণের জন্য এক্সাভেটর দিয়ে মাটি কাটায় পার্শ¦বর্তী আশরাফুজ্জামান বুদিম-এর তিনতলা মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। রোববার সকালে ওই মার্কেটের বেজ ঢালাই সংলগ্ন মার্টি কেটে গর্ত রায় মার্কেটের নিচ তলায় সুমি ট্রেডার্সের দেয়াল ধ্বসে প্রায় তিন লক্ষ টাকার মালামাল বিনষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুমি ট্রেডার্সের সত্বাধিকারী হাজী গোলাম মোস্তফা। তিনি ক্ষতিপুরুণও দাবি করেছেন। এই মুহুর্তে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ওই বিল্ডিংটি ধ্বসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ভবন মালিক ও দোকানদাররা।

মার্কেটের টেন্ডারের বিষয়ে পৌর প্রকৌশলী শামীম রেজা জানান, গত ১২ জানুয়ারী ঢাকা থেকে প্রকাশিত আমাদের সময় পত্রিকায় টেন্ডার আহবান করা হয় এবং চলতি মাসের ৯ তারিখে কাজের অনুমতি পান শহিদুল ট্রেডার্স। পৌরসভার নিজস্ব ব্যয়ে নির্মিত হবে পৌর মার্কেট। তবে পুরাতন শেড কিভাবে ভাঙ্গা হলো এ ব্যাপারে কোন জবাব দেননি তিনি। সেই সাথে টেন্ডার কমিটিতে কারা ছিলেন এবং ঠিকাদারের অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা, কিভাবে টেন্ডার দেয়া হলো সে ব্যাপারে মুখ খোলেননি তিনি। অপরদিকে মার্কেট নির্মানের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন রয়েছে কিনা এবং জমির মালিক প্রকৃতপক্ষে পৌরসভা কিনা সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি তার কাছ থেকে। অপরদিকে টিনের ছাউনির শেড ভেঙে পৌর মার্কেট নির্মাণের বিষয়ে বাঁধ সেধেছে মেহেরপুর জেলা পরিষদ। জানতে চাইলে, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম রসুল বলেন, বিতর্কিত জমিতে রাতের আঁধারে জোর পূর্বক মার্কেট নির্মাণের কথা তিনি শুনেছেন। সরকারীভাবে নির্মিত শেড কিভাবে পৌর কর্তৃপক্ষ ভেঙ্গে ফেলেছেন এবং ওই জমি কার তা দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। শেড ভাঙ্গার বিষয়ে পৌর মেয়র জেলা পরিষদকে অবগত করেননি। তাই আগামি ২৩ তারিখ পর্যন্ত নির্মান কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। ওইদিন পরিষদের সভা শেষে কাগজপত্র দেখা হবে। প্রকৃতপক্ষে জেলা পরিষদ ওই জমির মালিক কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আজিম উদ্দীনের ছেলেদের দাবি, গাংনী মৌজার সাবেক ২০৫৬ দাগের ০.১৩ একর জমি বাংলা ১৩৪২ সালে বন্দোবস্ত নিয়ে স্বত্তবান ও দখলীকার হন তারা। পরবর্তীতে মামলা ও সরকার পক্ষের আপিলের প্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী হাইকোর্ট তাদের পক্ষে রায় দেন। আজিম উদ্দীন মন্ডল মারা গেলে বড় ছেলে আব্দুল গনিসহ তার সাত ছেলে ও দুই কন্যা ওয়ারিশ হন। এছাড়াও আরএস রেকর্ড ভুল সংশোধনী জন্য ২০১৫ সালে মেহেরপুর যুগ্ম জেলা জজ ২য় আদালতে দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন আব্দুল গনি। যা চলমান রয়েছে।

এদিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গতরাতেও আব্দুল গনি ও তার পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুরা সেখানে অবস্থান করছিলো। তবে আজ সোমবার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসার কথা রয়েছে। উভয়পক্ষকে সকাল দশটায় সেখানে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, বিষয়টি দেওয়ানি। তাই এর সমাধান পুলিশের কাছে নেই। তবে সেখানে আইনশৃঙ্খলার কোন বিঘœ যাতে না ঘটে সেজন্য পুলিশের নজর রয়েছে।