গমে ব্লাস্ট প্রতিরোধে মেহেরপুরে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা

কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের সকলের ছুটি বাতিল

মাজেদুল হক মানিক: গমের ব্লাস্ট নামক ছত্রাক প্রতিরোধে মেহেরপুরে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা অবলম্বন করেছে কৃষি বিভাগ। গম ক্ষেতে প্রতিষেধক স্প্রে দেয়া শুরু হয়েছে। গমক্ষেত নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের সকলের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। গেলো দুই বছর মেহেরপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৮টি জেলায় ব্লাস্ট ছত্রাকের আক্রমণে কয়েক হাজার হেক্টর গম বিনষ্ট হয়। এতে এ অঞ্চলে গম আবাদ হুমকির মুখে পড়েছে। মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, তীব্র শীতের পর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকে রাত-দিনের তাপমাত্রার গড়ও স্বাভাবিকের চেয়ে গড়মিল রয়েছে। এ অবস্থায় রবি ফসলের রোগ-বালাই দেখা দিচ্ছে। ব্লাস্ট নামক ছত্রাক এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আক্রমণ করতে পারে। সেজন্য কৃষকদের আগাম সতর্ক বার্তা দেয়া হচ্ছে। গমে থোড় অবস্থায় একবার ও শীষ বের হয়ে গেলে আরেকবার নাটিভো, ফলিকোর ও ট্রোপার স্প্রে করতে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ মাঠে মাঠে গিয়ে গমক্ষেত পরিদর্শন করছেন। সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে গমক্ষেত। ব্লাস্ট আক্রান্ত হলে গমের শীষ বিনষ্ট হতে পারে। আক্রমণ ঠেকাতে না পারলে আরও কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে পারে গম আবাদ। চলতি মরসুমে কয়েকটি জায়গায় ব্লাস্টের নমুনা দেখা গেছে। তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে তা ছড়াতে পারেনি।

মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, গম বীজ বপণের আগে থেকেই কৃষকের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। বীজ শোধন ও ক্ষেতের প্রয়োজনীয় পরিচর্যার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এখন ব্লাস্ট ঠেকানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মীবৃন্দ। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরতদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

ধর্মচাকী গ্রামের কৃষক সামসুজ্জামান বলেন, গত বছর ব্লাস্টে আমার এক বিঘা জমির গম নষ্ট হয়ে যায়। এবার কৃষি বিভাগের পরামর্শে বীজ শোধন করে বপন করেছি ও থোড়ে নাটিভো স্প্রে করেছি। আশা করছি এবার ব্লাস্ট লাগবে না।

গাড়াডোব গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, ২০১৬ সালে আমার দেড় বিঘাসহ গ্রামের অনেক কৃষকের গম নষ্ট হয় ব্লাস্টে। এবার আমরা সতর্ক রয়েছি। নিয়মিত ক্ষেত দেখাশুনা করছি। এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। কৃষি বিভাগের পরামর্শে স্প্রে অব্যাহত রেখেছি।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে মেহেরপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৮টি জেলায় গমে ব্লাস্ট নামক ছত্রাকের আক্রমণ দেখা যায়। মাঠ পর্যায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন কৃষি বিজ্ঞানীরা ও আন্তর্জাতিক গম এবং ভুট্টা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। ব্লাস্টের আক্রমণ চিহ্নিত করার পর হাজার হাজার হেক্টর ক্ষেতের গম পুড়িয়ে দেয়া হয়। গেলো দুই বছর এ অঞ্চলে গম বীজ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় বিএডিসি। তবে চাষিদের ঘরের বীজ ও বিভিন্ন কোম্পানির বীজ দিয়ে স্বল্প পরিসরে চাষ হয়। ব্লাস্টমুক্ত করতে পর পর তিন বছর এ অঞ্চলে গম আবাদে নিরুৎসাহিত করে কৃষি বিভাগ। মাঠ পর্যায়ে শতভাগ আবাদ বন্ধ হয়নি।  গেলো বছর মেহেরপুর জেলায় স্বল্প পরিমাণে গম আবাদ হয়। এতেও ব্লাস্টের আক্রমণ হয়েছিলো। চলতি বছরেও গম আবাদে নিরুৎসাহিত করে কৃষি বিভাগ। যারা আবাদ করেছেন তাদের প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক দেয়ার পরামর্শ দেন কৃষি কর্মকর্তারা। সঙ্কট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে গম গবেষকরা ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত উদ্বাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। বারি গম ৩৩ নামে জাতীয় বীজ বোর্ড এ মরসুমে জাতটির অনুমোদন দিয়েছে। খামার ও কৃষক প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে চলতি মরসুমে বিভিন্ন এলাকায় জাতটি আবাদ হচ্ছে। আগামি মরসুম থেকে চাষি পর্যায়ে বীজ সরবরাহ করা যাবে বলে আশা করছে বিএডিসি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় চলতি মরসুমে ৬ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে গম আবাদ হয়েছে। রবি ফসলে (গম, ভুট্টা, মসূর, সরিষা ইত্যাদি) সম্মৃদ্ধ জেলায় গেলো দুই বছরে গম আবাদে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে চাষিদের আরও সচেতনতা ও ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাত সম্প্রসারণের বিকল্প নেই বলে জানালেন কৃষি কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালে বিশে^ প্রথম ব্লাস্ট আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে ব্রাজিলে। ব্লাস্ট ছড়িয়ে পড়ে ল্যাট্রিন আমেরিকার দেশগুলোতে। উল্লেখযোগ্য গম উৎপাদনের ওই দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকার ফলে ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।