কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ভারত সীমান্ত গলিয়ে বেড়েছে গরু পাচারের পরিমাণ

কয়েকটি সংস্থার নামে তোলা হচ্ছে অর্থ : ফসকে যাচ্ছে রাজস্ব

 

স্টাফ রিপোর্টার: কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ভারত সীমান্ত গলিয়ে গরু পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। পাচার করে আনা গবাদি পশুর বেশি ভাগই রোগাক্রান্ত বলে অভিযোগ। জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় ওগুলো পরীক্ষা তো হচ্ছেই না, উপরন্ত করিডোর করও অনেক ক্ষেত্রেই দেয়া হচ্ছে না।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের জিরো পয়েন্টে গরু দিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সীমান্ত দিয়ে এ দেশে গরু বিক্রির নামে ঢুকে পড়ে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক বেচাকেনা করে চলে যাচ্ছে। এসব প্রকাশ্যে ঘটলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের কাছে কাড়ি কাড়ি টাকা আয়ের লোভে এতো বড় ঘটনা না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে সরকার বদলের সাথে সাথে ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় সমস্ত চোরাচালান ও অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে ওই এলাকার প্রভাবশালী সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। তারা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অবৈধ টাকা আয়ের নেশায় মত্ত রয়েছে।

সীমান্তবর্তী এলাকায় অনুসন্ধান করে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার মুন্সিপুর, কুতুবপুর, ঠাকুরপুর, বারাদী, রাজাপুর, মদনা ও জীবননগর উপজেলার ধোপাখালী, নতুনপাড়া, মেদেনীপুর, বেনীপুর এবং ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার বাঘাডাঙ্গা, শ্যামপুর ও শ্রীনাথপুর। এছাড়াও মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার আনন্দবাস সীমান্ত দিয়ে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ভারত থেকে অবৈধ উপায়ে গরু-মোষ বাংলাদেশ আভ্যন্তরে বন্যার পানির মতো ঢুকছে। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ভারত সীমান্ত দিয়ে যে সকল গবাদি পশু বাংলাদেশে ঢোকে সেগুলোর রাজস্ব জগন্নাথপুর (কার্পাসডাঙ্গা) গবাদি পশু শুল্ক করিডোরে এবং জীবননগর উপজেলা ও ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা দিয়ে ঢোকা পশুগুলোর রাজস্ব কুসুমপুর গবাদি পশু শুল্ক করিডোরে জমা দেন ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, শ শ গরু-মোষ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকলেও শতকরা ৩০ ভাগ পশুর রাজস্ব সরকার পায়। বাকিটা সীমান্ত এলাকার দালাল, লাইনম্যান, বিজিবি সদস্য ও তাদের গোয়েন্দা, সীমান্তবর্তী এলাকার থানা ও ডিবি, ডিএসবি সমঝোতার মাধ্যমে ভাগাভাগি হয়। তবে লাইনম্যান ও দালালদের অভিযোগ, ভারত-বাংলাদেশের অবৈধ কারবারের কাজে সহযোগিতা করার জন্য যে অবৈধ টাকা রোজগার হয় তার ৮০ ভাগই পান বিজিবির কোম্পানি কমান্ডার ও বিওপির সদস্যরা। আর বাকি ২০ ভাগ ভাগবাটোয়ারা হয় অন্যদের মাঝে।

তারা আরো জানান, ভারত থেকে অবৈধ উপায়ে আসা প্রতিটি গরু-মোষ এদেশে হালাল করতে বিজিবিকে দিতে হয় ৩০০ টাকা, সীমান্তবর্তী থানা পুলিশ পায় ৩০০ টাকা, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) পায় ১০০ টাকা, বিজিবির গোয়েন্দা নামে আদায় করা হয় ১০০ টাকা ও শুল্ক করিডোরে কাগজ লেখা বাবদ দিতে হয় ১০০ টাকা। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থানার ক্যাশিয়ার কার্পাসডাঙ্গার হাকিম ও বিজিবির ক্যাশিয়ার মুন্সিপুর গ্রামের শুকুর ও ফারুক টাকা তুলে তা সংশ্লিষ্ট জায়গায় দিয়ে আসে। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার মুন্সিপুর ও ঠাকুরপুর ও জীবননগর উপজেলার হরিহরনগর, বেনীপুর ও ধান্যখোলা গ্রামের ভারত সীমান্ত গলিয়ে সবচেয়ে বেশি অবৈধ গরু-মোষ বাংলাদেশে ঢোকে। মুন্সিপুর গ্রামের খোকার ছেলে অত্যন্ত প্রভাবশালী ফারুক, একই গ্রামের মক্কর সরদারের ছেলে শুকুর, মরহুম জেরমান মল্লিকের ছেলে ফজলু, মরহুম ক্ষুদে বিশ্বাসের ছেলে কালু বিশ্বাস ও হযরত সরদারের ছেলে বুড়ো এবং হরিহরনগর গ্রামের আমির হোসেন, কবির উদ্দিন, আব্দুল করিম, সৈয়দ আলী, শহিদুল ইসলাম ও আব্দুল হান্নান, বেনীপুর গ্রামের সবুজ হোসেন, আসাদুল হক ও আব্দুল রশীদ এবং ধান্যখোলা গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেন ভারতের অবৈধ গরু-মোষ কেনাবেচা করে। এরা এতোই প্রভাবশালী যে এদের বাড়িতে ভারতীয় (কথিত গরুব্যবসায়ী) নাগরিক দিনের পর দিন অবৈধভাবে এসে থাকে। এই অবৈধ ভারতীয় নাগরিকরাই প্রকাশ্যে এদেশে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা করে চলে যায়। ভারতীয় নাগরিকরা খোলামেলা ভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজে নিয়োজিত লোকজনের সামনে ঘোরাফেরা করলেও তারা তাদের কিছু বলে না। মুন্সিপুর গ্রামের ফারুক ভারত থেকে অবৈধ উপায়ে যে সকল লোকজন কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকে তাদের কাছ থেকে সে সর্বনিম্ন পাঁচশ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা করে নেয় বলে ওই এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছে। সে লোকজনের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে এ টাকা আদায়সহ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় অবৈধ নাগরিকদের সহযোগিতা করে। গরু-মোষের ব্যবসার নাম করে বিজিবির ক্যাশিয়ার ফারুক ও শুকুরের সাথে যারা দালালি বা লাইনম্যানের কাজ করে তারা আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফারুক ও শুকুরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে একই গ্রামের মরহুম ইউনুস মাস্টারের ছেলে গরুব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বলেন, ভারতের নাগরিকরা গরু-মোষ নিয়ে এদেশে আসে। ওগুলো বিক্রি করে টাকা নিয়ে তারা চলে যায়। এছাড়া ফারুক ও শুকুর ভারত থেকে অবৈধ উপায়ে আসা গরু-মোষ মাথাপিছু হিসাব করে বিজিবির পাওনা টাকাগুলো তুলে ক্যাম্পে দিয়ে আসে। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা করা বা এ কাজে অন্যদের সহযোগিতা করার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, যারা এটা বলেছে তারা ঠিক বলেনি।

ভারত থেকে যে সব গরু-মোষ অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেগুলো রাখার জন্য সীমান্তবর্তী গ্রামে নির্দিষ্ট কিছু জায়গা থাকে। সেগুলো গোঁজ নামে পরিচিত। ভারতীয় অবৈধ গরু-মোষ এ গোঁজগুলোতে জড়ো করা হয়। কতোটি অবৈধ গরু-মোষ এখানে জড়ো হলো, তা দেখে ছাড়পত্র দেয় বিজিবি। এরপর ওই ছাড়পত্র পেয়ে গোঁজ মালিকরা গবাদি পশু শুল্ক করিডোরে গিয়ে সেখানে ভারতীয় গরু-মোষ না দেখিয়েই প্রতিটি মাথাপিছু পাঁচশ টাকা করে রাজস্ব রসিদ কাটিয়ে নেয়। জগন্নাথপুর (কার্পাসডাঙ্গা) গবাদি পশু শুল্ক করিডোরের কার্যালয় সহকারী গোলাম কিবরিয়া বলেন, শুধুমাত্র গোঁজ মালিকরা গরু-মোষের গায়ের রঙের বিবরণ দিলেই শুল্ক পরিশোধের রসিদ কেটে দেয়া হয়। চারদিন সময়ের এ রসিদ যার কাছে থাকে, সে তখন অবৈধ গরু-মোষের বৈধ দাবিদার হয়ে যায়। এ রসিদ সাথে রেখে গরু-মোষগুলো হাটেবাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আরো জানান, করিডোরে ৭ সেপ্টম্বর থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। এছাড়া চলতি মাস অর্থাৎ ৭ অক্টোবর রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। অভিযোগ রয়েছে, জগন্নাথপুর (কার্পাসডাঙ্গা) গবাদি পশু শুল্ক করিডোরের দায়িত্বে কাস্টমস্ ইন্সপেক্টর হাশেম আলী থাকলেও অফিস করেন না। মাঝেমাঝে তিনি খুলনা থেকে এসে খাতাপত্রে স্বাক্ষর করে চলে যান। কাস্টমসে সিপাই গোলাম কিবরিয়া একাই করিডোরের আদায় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।

নিয়ম অনুযায়ী একজন ব্যবসায়ী শুল্ক রসিদ নিয়ে হাটেবাজারে গরু-মোষ বিক্রি করতে না পারলে তা বিজিবি ক্যাম্পে রাজস্ব রসিদসহ এসে জানাতে হবে। কিন্তু প্রথম দিনই গরু-মোষ বিক্রি করে দিয়ে ব্যবসায়ীরা পুরোনো রাজস্ব রসিদ ব্যবহার করে আবারও রসিদে বর্ণিত রঙের অন্য গরু-মোষ বিক্রির জন্য হাটেবাজারে নিয়ে যায়। মজার বিষয় হলো, এ ধরনের রাজস্ব ফাঁকি কারসাজি থাকলেও বিজিবির কথিত লাইনম্যানকে গরু-মোষ অনুযায়ী মাথাপিছু টাকা দেয়ার কারণে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যায় বলেও অভিযোগ। তবে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গরু-মোষ মালিকদের কাছ থেকে নানা কারণ দেখিয়ে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে। জগন্নাথপুর গ্রামের গোঁজ মালিক সাগর, আনোয়ার, আসাদুল ও মুন্সিপুর গ্রামের ইসমাইল, মনিরুল, আবেদ আলী, গোলাম, তোহির ও শুকুর আলী বলেন, কতিপয় ব্যক্তি এ জাতীয় কাজ করলেও আমরা তা করি না। সরকার রাজস্ব পাক তা আমরা চাই।

ভারত থেকে অবৈধভাবে আসা রোগাক্রান্ত গরু-মোষ বাংলাদেশে ঢোকার পরও চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ দফতরে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকে না। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে অবৈধ রোগাক্রান্ত ভারতীয় পশু কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই জেলার হাটবাজারগুলোতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ভারত থেকে অবৈধভাবে বন্যার পানির মতো রোগাক্রান্ত গরু-মোষ এদেশে ঢুকছে। আর অবৈধ টাকার বিনিময়ে বিজিবি এটাকে জায়েজ করে দিচ্ছে। এটা অনৈতিক কাজ বলে অনেকে মত প্রকাশ করেছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. কোহিনুর ইসলাম বলেন, আমরা ভারত থেকে অবৈধ পথে আসা রোগাক্রান্ত পশু পরীক্ষা করতে চাইলেও বিজিবির কারণে তা হচ্ছে না। তারা এ কাজে আমাদের সহযোগিতা করেন না। তাছাড়া শুল্ক করিডোরে আমাদের পশু চিকিৎসকরা বসে থাকলেও সেখানে গরু-মোষ আনা হয় না।

চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল গাজী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা মূলত সীমান্তরক্ষা কাজে নিয়োজিত থাকি। তবে ভারত থেকে যে সব গবাদি পশু জিরো পয়েন্টে দিয়ে এদেশে ঢোকে সেগুলো রাজস্ব পরিশোধের মাধ্যমে বৈধতা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা করি। গবাদি পশুপ্রতি বিজিবির টাকা নেয়ার বিষয়টি তিনি পুরোপুরি অস্বীকার না করে বলেন, এমনটি হতে পারে। তবে আমাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দিলে আমরা তাদের ব্যাপারে বিভাগীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো।

ডিঙ্গেদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ভারতীয় গরুতে বাজার সয়লাব। বিপাকে পড়েছেন গরু মালিকরা।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গোখাদ্যের দাম বৃদ্ধি এবং গরুর মূল্য কমে যাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছে ঝিনাইদহের গরু মোটাতাজাকরণ করা খামারিরা। পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এবার ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ১০ হাজার গরু মোটাতাজাকরণ করেন খামারিরা। ভারতীয় গরুর চাপে খামারিদের এবার লোকসানের বোঝা বহুগুনে বেড়ে যাচ্ছে।