কপাল পুড়েছে মুজিবনগরে সুখ সাগর পেঁয়াজ চাষিদের

 

মাজেদুল হক মানিক/শেখ শফি: নিম্ন মানের বীজ, সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা এবং অনাকাঙ্খিত বৃষ্টিতে এবার ধরাশায়ী মেহেরপুরের সুখ সাগর পেঁয়াজ চাষিরা। বেশ কয়েক বছর ধরে এ পেঁয়াজ চাষে চাষিদের কপালে সুখ জুটলেও সেইসব চাষিদের এখন মাথায় হাত। একদিকে ফলন বিপর্যয় অন্যদিকে প্রায় পানির দামে পেঁয়াজ বিক্রি হওয়ায় চাষিরা এখন দিশেহারা।

সবজি খ্যাত জেলা মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার প্রায় সব মাঠজুড়ে সুখ সাগর পেঁয়াজের চাষ বেশ জনপ্রিয়। সুখ সাগর পেঁয়াজ এ উপজেলার চাষিদের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে আবাদ হচ্ছে। এ  উপজেলায় হাজার হাজার কৃষক সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজের চাষ করে দারিদ্র্যতা ঘুচিয়ে আজ ধনীর কাতারে নাম লিখিয়েছেন। চলতি মরসুমে ২ হাজার ৯শ’ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। উচ্চফলনশীল এই সুখ সাগর পেঁয়াজ বিঘা প্রতি ১৫০ থেকে ২০০ মণ পর্যন্ত ফলন পান কৃষকেরা। কিন্তু চলতি মরসুমে ফলন দাঁড়িয়েছে ৬০-৮০ মণে।

স্থানীয় তাহেরপুরি জাতের পেঁয়াজের ফলন হয় বিঘায় মাত্র ২০ থেকে ২৫ মণ। ১৫ থেকে ২০ বছর আগে ভারত থেকে বীজ এনে প্রথম মুজিবনগর উপজেলায় এ পেঁয়াজের আবাদ শুরু করেন চাষিরা। দ্রুত তা জেলার চাষিদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পেঁয়াজের মরসুমে মাঠের পর মাঠ জুড়ে পেঁয়াজক্ষেত চোখে পড়ে। এখানকার উৎপাদিত পেঁয়াজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। তবে চলতি মরসুমে চাষিদের উদ্যোগে ভারত থেকে আনা পেঁয়াজ বীজ নিম্নমানের হওয়ায় বিপাকে পড়েন তারা। ২ দফা বীজ বপণ করে ফসল ফলানো হলেও ফলন বিপর্যয় হচ্ছে। প্রতি বিঘায় মাত্র ৬০-৮০ মণ পেঁয়াজ পাচ্ছেন চাষিরা। অপরদিকে স্থানীয় পাইকারী বাজারে ৬-৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে সুখ সাগর পেঁয়াজ। জেলায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পচনশীল এই কৃষি পণ্য পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। এতে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন সুখ সাগর পেঁয়াজ চাষিরা।

মুজিবনগর উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামের পেঁয়াজচাষি আসান আলী জানান, চলতি মরসুমে তিনি ৪ বিঘা জমিতে সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। এবার আগাম গরম হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় পেঁয়াজে রোগ-বালাই ব্যাপকভাবে দেখা দেয় এতে গত কয়েক বছরের চেয়ে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে।

একই গ্রামের চাষি আলী রাজ ও মনিরুল ইসলাম জানান, মরসুমের শুরুতেই তারা এবার ধরাশায়ী। ভারত থেকে চোরাইপথে আনা পেঁয়াজ বীজ মানসম্মত ছিলো না। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেতের পেঁয়াজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। এতে আবারো বীজ সংগ্রহ করে আবাদ করা হয়। বীজের কারণেও এবার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। শুধু বীজ কিংবা কীটনাশকই নয় ফলন বিপর্যয়ে পড়ে মারাত্মক লোকসানের মুখোমুখি এ অঞ্চলের পেঁয়াজ চাষিরা।

মানিকনগর গ্রামের জিয়ারুল ইসলাম জানান, গত বছরের চেয়ে প্রায় ১শ’ মণ ফলন কম হচ্ছে। তার ওপরে আবার পেঁয়াজের দাম পড়ে যাওয়ায় লাভ তো দূরের কথা চাষের খরচই উঠবে না। ফলে প্রান্তিক চাষিরা এবার ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছেন। চাষিরা জানান, অগ্রীম গরম আবহাওয়ার পাশাপাশি গত ৮ ফেব্রুয়ারি মুজিবনগর উপজেলার ওপর দিয়ে শিলাবৃষ্টি হওয়ায় মারাত্মক ফলন বিপর্যয়ে মুখে চাষিরা। দারিয়াপুর, বাগোয়ান ও মোনাখালী ইউনিয়নের মাঠগুলোতে শিলাবৃষ্টির আঘাতে মাটির সাথে নুইয়ে পড়ে পেঁয়াজ গাছ। বেশিরভাগ জমিতে ২/৩ দিন জলাবদ্ধতা ছিলো। এতে পেঁয়াজের গোড়া পচে যায়। এতে ক্ষেত পরিচর্যায় আবারো নতুন করে কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। চাষের বিভিন্ন দফায় খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি পেঁয়াজ সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় চাষিদের ভাগ্যে জোটে আরেক বিপত্তি। দ্রুত পচনশীল এই পেঁয়াজ তাই তড়িঘড়ি করে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। স্থানীয় পর্যায়ে কোনো হিমাগার (কোল্ডস্টোরেজ) না থাকায় চাষিরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এতে পানির দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। হিমাগারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে দু/এক মাস পরেই বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব হতো বলে জানান কৃষকরা।

পেঁয়াজ সংরক্ষণে সরকারি তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে জেলায় হিমাগার স্থাপনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক এসএম মোস্তাফিজুর রহমান। জেলায় ব্যাপক ভাবে সবজি ও রবি ফসল উৎপাদন হওয়ায় একদিকে যেমন চাষিরা উপকৃত হবেন তেমনি হিমাগার মালিকরাও এ ব্যবসায় লাভবান হবেন বলে আশার কথা শোনান তিনি।