ঐতিহাসিক গণভোটে ইউ ছাড়ছে ব্রিটেন

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল ইউরোপের দেশগুলো। একটি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দেশগুলোর মধ্যে। ১৯৭৩ সালে সেই স্বপ্নের অংশীদার হয়েছিল ব্রিটেন। কিন্তু ৪৩ বছরে তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। ফলে সেই সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটল ব্রিটেনের। বৃহস্পতিবার ঐতিহাসিক গণভোটে একলা চলার পক্ষেই রায় দিল ব্রিটেনবাসী। গতকাল শুক্রবার জানা গেল সেই রায়ের ফল। এই রায় কেবল ব্রিটেনকে আন্দোলিত করেনি, সারা বিশ্বেই এর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আস্থার সম্পর্কে ভাঙন ধরায় হুমকির মুখে পড়ল ইইউ। রায়ের ফল বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশের পরই বিশ্বের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়। ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের ব্যাপক পতন ঘটে যা ১৯৮৫ সালের পর এই প্রথম। অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে গেছে রাজনীতি আর কূটনীতি। এই গণভোটের রায় ব্রিটেনের অন্যতম সাংবিধানিক রাষ্ট্র স্কটল্যান্ডকে স্বাধীন হতে যেমন সহায়তা করতে পারে তেমনি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর জন্যও ইইউ ছাড়ার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো বলেই ধারণা করা হচ্ছে। রায় জানার পরই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন গণভোট ইস্যুতে চাপে থাকা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তবে এখনই ব্রিটেন ইইউ ছাড়ছে না। পার্লামেন্ট ইচ্ছা করলে এই গণভোটের রায় নাও মানতে পারে। কিন্তু দেশটিতে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকায় এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যদিও ইইউ কমিশনের নেতা যত শিগগিরই সম্ভব ব্রিটেনকে ইইউ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অনেকের মতে, যে ব্রিটেনের কাছ থেকে বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেই ব্রিটেন আজ স্বাধীন হলো। কেউ আবার ব্রিটেনের জন্য ২৩ জুন রেড লিটারস ডে, আবার কেউ বলছেন, ব্রিটেনের জন্য ২৩ জুন একটি দুঃখের দিন।

ভোটের হিসাব: ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে গড়ে তোলা হয়েছিলো আফ্রিকান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন। আশাবাদ জেগেছিল এশিয়া মহাদেশে তথা দক্ষিণ এশিয়ায় এরকম সংগঠন গড়ে তোলার। সেই আশায় চিড় ধরল বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার ৪০ হাজার কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েলসে একই সঙ্গে ভোট নেওয়া শুরু হয়। ৩৮২টি আসনের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পর দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে (লিভ) রায় দিয়েছেন ১ কোটি ৭৪ লাখ ১০ হাজার ৭৪২ জন ভোটার (৫২ শতাংশ)। আর ইইউতে থাকার পক্ষে (রিমেইন) ভোট দিয়েছেন ১ কোটি ৬১ লাখ ৪১ হাজার ২৪১ জন (৪৮ শতাংশ)। ৭২ দশমিক ১৬ শতাংশ জনগণ গণভোটে তাদের মত দিয়েছেন যা গত সাধারণ নির্বাচনে পড়া ভোটের হারের চেয়ে বেশি। ১৯৯২ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর এটাই সর্বোচ্চ হার। আঞ্চলিক হিসাবে স্কটল্যান্ডে ‘রিমেইন’ এ ভোট পড়েছে ৬২ শতাং, ওয়েলসে ‘লিভ’ এর পক্ষে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ, উত্তর আয়ারল্যান্ডে ‘রিমেইন’ এ ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ, লন্ডনে ‘রিমেইন’ এ ৫৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ইংল্যান্ডের অন্যান্য এলাকায় ‘লিভ’ এর পক্ষে গেছে ৫৭ শতাংশ ভোট। ২৬ হাজার ৩৩ ব্যালট পেপার বাতিল হয়েছে।

ব্রিটিশ সরকার আগেই জানিয়েছিলো, গণভোটের রায় যাই হোক, তা মেনে নেবে সরকার। গতকাল ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেল, আশঙ্কাটাই সত্যি হয়েছে। ২৮টি দেশের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়েই যাচ্ছে ব্রিটেন। ইইউতে থাকা এবং বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে গত চার মাস ধরে প্রচার উঠেছিলো তৃঙ্গে। এমনকি ইইউ’র এর পক্ষে থাকার জন্য বিরোধী লেবার পার্টির এমপি জো কক্সকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, এমপি’র হত্যাকান্ডের পর হয়তো ইইউতে থাকার পক্ষেই গণভোটে রায় আসবে। এমনকি গত তিন দিন আগে থেকে বিভিন্ন জরিপে ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ধীরে ধীরে কমেছিলো। কিন্তু সব জরিপ মিথ্যা প্রমাণ করে অবশেষে ঐতিহাসিক রায় দিল জনতা। প্রথম থেকেই ডেভিড ক্যামেরন ইইউতে থাকার পক্ষে ছিলেন। গত বছরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনি ব্রিটেনবাসীকে এই গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন। কিন্তু যে আশায় তিনি গণভোট দিয়েছিলেন সেই আশা ভেঙে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ব্রিটেনের নাগরিকদের তিনি ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিজের ভোটটি দিয়ে বেরিয়ে আসার পরও বলেছিলেন, ‘ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিলে তা হবে একটি বিরাট ভুল।’ কিন্তু গণভোটের ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেল, ক্যামেরনের দল কনজারভেটিভ পার্টির (টোরি) শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত সান্ডারল্যান্ডেও ৬১ শতাংশ ভোটার রায় দিয়েছেন ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে। একটু পিছিয়ে পড়া এলাকা নানইটনও গোটা দেশের জনমতের থেকে পিছিয়ে থাকেনি। ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে ভোট দিয়েছেন নানইটনের ৬৬ শতাংশ মানুষ।

খুশি ব্রিটেনের আমজনতা: আশঙ্কা দেখা দিয়েছে,  ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্তের জেরে বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম অর্থনীতিতে কমবে বিনিয়োগের হার যা বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী হিসেবে লন্ডনের যোগ্যতা সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলে দিতে বাধ্য। উল্লেখ্য, ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়া কেন্দ্র করে ব্রেক্সিট ভোট নিয়ে দোলাচল শুরু হতেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে অনিশ্চিয়তা দেখা দেয়। শুরু হয় সোনাসহ তুলনামূলক নিরাপদ সম্পদে লগ্নির প্রবণতা। তার জেরে দ্রুত বাডড়ত শুরু করে ইয়েনের দাম।

বাজার প্রতিক্রিয়া যাই হোক, ব্রেক্সিট ভোটের ফলাফলে উচ্ছ্বসিত ব্রিটেনের সাধারণ মানুষ। ভোটে ফল পাওয়ার পর অনেককে বিভিন্ন রাজ্যে রাস্তায় উল্লাস করতে দেখা গেছে। বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষের লোকজন লন্ডনে বিজয়োল্লাস করেছে। বড় কেক কেটে ও শ্যাম্পেন উত্সব করেছে তারা। অন্যদিকে লন্ডনের রয়্যাল ফেস্টিভ্যাল হলে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের মধ্যে ছিল চরম হতাশা। সেখানে তারা গালে-মুখে হাত দিয়ে টিভির সামনে বসে ছিল। সেন্ট্রাল লন্ডনের লেক্সিনটন বারে যেসব সমর্থক বসে ছিলেন, তাদের মধ্যে হতাশা বেড়েই চলছিল। জনমত অনুসারে ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং আন্তর্জাতিক ও শিল্পজগতের তাবড় নেতৃত্বের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই দেখা হচ্ছে গণভোটের ফলাফল।

কেন এই হার: রিমেইন গ্রুপের পক্ষের মানুষের যুক্তি ছিলো ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করলে ব্রিটেনের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা সংকটের মুখে পড়বে। কিন্তু সেই যুক্তি মানেনি অধিকাংশ মানুষ। আর লিভ গ্রুপের যুক্তি ছিলো, ব্রিটেন স্বাধীন নয়, কোনো কিছু করতে হলেই ইইউ এর সহায়তা নিতে হয় বা তাদের মাতব্বরিকে গ্রহণ করতে হয়। ইইউভুক্ত অভিবাসীদের চাপে চাকরির বাজার হারাচ্ছেন প্রকৃত ব্রিটিশরা। নিজ দেশেই তারা যেন পরবাসী হয়ে উঠেছিলেন। ভোটের দুই তিন দিন আগেও ইইউতে থাকার পক্ষে ৪৫ শতাংশ মানুষের সমর্থণ ছিল। আর বিপক্ষে ছিল ৪৪ শতাংশ মানুষের সমর্থন। বাকি ১১ শতাংশ কোনো পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু বিভিন্ন জরিপে এই ১১ শতাংশকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়েছিলো। সেটাই সত্যি হলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ১১ শতাংশের বেশিরভাগ ভোট গেছে ইইউ ছাড়ার পক্ষে। আর সেই কারণেই ডেভিড ক্যামেরন শত চেষ্টা করেও জয়কে আলিঙ্গন করতে পারেননি।

এখনই বিচ্ছেদ নয়: আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুদিনের মধ্যেই ব্রেক্সিটের ফলাফল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোকে জানাবেন ক্যামেরন। তারপরই শুরু হবে আইনত ব্রিটেনের ইউনিয়ন ছাড়ার প্রক্রিয়া। গণভোটের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইইউর সঙ্গে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ঘটবে না। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। ২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়া লিসবন চুক্তিকে বলা হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম সাংবিধানিক ভিত্তি। তারই আর্টিকেল-ফিফটিতে (৫০) বলা হয়েছে, এই জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নিয়ম-কানুন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আর্টিকেল-ফিফটি অনুযায়ী জোট ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তারপর অন্তত দুই বছর বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আলোচনা চলতে পারে। ওই আলোচনাতেই ঠিক করা হবে ব্রিটেন কোন প্রক্রিয়ায় ইইউ ছাড়বে। এর আগে এ ধরনের নজির না থাকায় ইইউ আর ব্রিটেনকেই লিখতে হবে বিচ্ছেদের রীতি-নীতি। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন গতকাল জানিয়েছেন, আগামী অক্টোবরে কনজারভেটিভ পার্টির সম্মেলন পর্যন্ত তিনি ডাউনিং স্ট্রিটে থাকছেন। তারপর তার উত্তরসূরি হিসেবে দল যাকে মনোনীত করবে, তার উপরই আর্টিকেল-ফিফটি কার্যকর করার দায়িত্ব দেবেন তিনি। ইইউ’র নিয়ম অনুযায়ী, আর্টিকেল-ফিফটি চালু করা দেশ এরপর আবারও কখনও জোটে ফিরতে চাইলে সব সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন প্রয়োজন হবে। অবশ্য গণভোটের রায় মানার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যেহেতু সার্বভৌম, সেহেতু সরকার গণভোটের রায় বিচারের সিদ্ধান্ত পার্লামেন্টের হাতে দিতে পারে। আর পার্লামেন্ট চাইলে আর্টিকেল-ফিফটি চালু না করার সিদ্ধান্ত দিতে পারে। সেক্ষেত্রে বিচ্ছেদও ঘটবে না। শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংবিধানিক ও কূটনৈতিকভাবে দীর্ঘ সময়জুড়ে বড় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে ব্রিটেনকে। বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে ব্রিটেনকে আর ইইউ’র সঙ্গে এক করে দেখানো হবে না। অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, ইইউ ত্যাগ করলে ইইউভুক্ত অন্য দেশে কাজ করতে গেলে ব্রিটিশদের কি বিশেষ অনুমতির দরকার হবে? উত্তর হলো, বের হয়ে যাওয়ার পর ইইউর সঙ্গে ব্রিটেনের নতুন চুক্তির ওপরই তা নির্ভর করছে। যদি একক বাজারব্যবস্থা টিকে থাকে, তবে অবশ্যই ব্রিটিশরা অন্য দেশগুলোতে সরাসরি যেতে পারবেন। আবার বিপরীতে  ইইউভুক্ত অন্য দেশের নাগরিকেরাও কাজ করতে ব্রিটেনে আসতে পারবেন কি না, তাও নির্ভর করবে সম্ভাব্য চুক্তির পর। ব্রিটেনের ত্যাগের পক্ষেই ভোট পড়ারও পরও তা কার্যকর হতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে।