একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী জুলমত আলী এবং রাষ্ট্রের দায়

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক জুলমত আলীর ভাগ্যে জোটেনি ১০ টাকা মূল্যের চাল প্রাপ্তির সৌভাগ্যের কার্ড। খেয়ে না খেয়ে কামারের তৈরি হুইল চেয়ারে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করে চলছে তার অভিশপ্ত দিনাতিপাত। বেঁচে থাকার সংগ্রামে রাষ্ট্রের ন্যূনতম সহানুভূতিও তার ভাগ্যে জোটেনি।

জানা গেছে, আলমডাঙ্গার কালিদাসপুর ইউনিয়নের নওদাপাড়া গ্রামের মৃত হবিবর মণ্ডলের ছেলে হতদরিদ্র  জুলমত আলী (৫২)। কাজ করতেন ইটভাটায়। ইটভাটায় কাজ করার এক পাজার ওপর থেকে পড়ে যান তিনি। এতে কোমরে প্রচণ্ড চোট পান। সে সময় ভালোভাবে চিকিৎসা পাননি। ফলে যতো বয়স বেড়েছে, ততোই সে সমস্যা তীব্রতর হয়েছে। ইটভাটার শক্ত কাজ আর করতে পারেন না। এমতাবস্থায় অভাবে তাড়নায় ভিটেবাড়ি খুইয়ে পা রেখেছিলেন নদী পারে আলমডাঙ্গায়। ভেবেছিলেন – শহরে তো অনেকেই কিছু না কিছু করে খাচ্ছে। তার মতো অনেক হতদরিদ্র দিব্যি আছে। ভালোই আছে। যদিও বউ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে চাইনি। কিন্তু দারিদ্রের সর্বগ্রাসি ছোবলে সে আবেগ ফিকে হতে সময় নেয়নি। প্রথম প্রথম শহরে ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে তার ছোট সংসার পাতেন। সারাদিন কষ্ট কলা ফেরি করে বিক্রি করতেন। যা উপার্জন করতেন, তা দিয়ে কখনও কিছুটা কষ্টে আবার মাঝে-মধ্যে কিছুটা সাচ্ছন্দেই কাটছিলো দিনগুলি। কিছু কিছু করে টাকা গুছিয়ে একটা গরুর বাছুর কিনেছিলেন। একদিকে তার গরুটি বড় হচ্ছিলো, অন্যদিকে তার নিজের কোমর থেকে দু পা অসাড় হয়ে আসছিলো। হাঁটার শক্তি এক সময় লোপ পায়। ফলে গরু বিক্রি করে দিলেন। গরু বিক্রির টাকায় একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিলেন। বাকি ৮ হাজার টাকায় কিনলেন হুইল চেয়ার। এ কাহিনি ৮ বছর আগের। এরপর শুরু হলো কষ্টের করুণ কাহিনি। অসুখে তো বউর জীবন গেলো। দারিদ্রের অভিশাপ আর একা জীবনের নৈরাশ্য তাকে কুরে কুরে খাসছিলো। তিনি আক্রান্ত হলেন কঠিন ব্যাধিতে। এমন ব্যাধি যে তার নিজের পক্ষে ভালো চিকিৎসা হওয়াও সম্ভব হলো না। ফলে চির তরে হারালেন দু পায়ের শক্তি। এখন হুইল চেয়ারেই সর্বক্ষণ বসে থাকেন তিনি। দাঁড়াতে পারেন না। এখন নেহায়েত কপালের ফের বলেই এক সময় এ দুর্ভাগ্য মেনে নিয়েছেন জুলমত আলী। পরিশ্রম করে সমাজে আর দশটা গরীবলোকের মত জীবন চালানোর সাধ থাকলেও আর সাধ্য নেই। জুলমত আলীর নিজের ভাষায় বউ দেখতে ভালোই ছিলো। শ্যামা ঘাসের মতো শরীল দেখে তেই বিয়ে করছিলাম। অনেক কষ্ট করছি তাই বলে বউকে কারও বাড়ি কাজ করতি দিইনি। গতর খাটিয়ে প্যাট চালাতাম। আর এখন? বাধ্য হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী জুলমত আলী এখন ভিক্ষাবৃত্তি বেঁছে নিয়েছে। বর্তমানে জুলমত আলী আলমডাঙ্গা পৌর শহরের ২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। স্টেশন রোডের ধারে একটা ক্লাবঘরে মানবেতর জীবনযাপন করেন। দেখভালো তো দূরে থাক – খোঁজটুকু নেওয়ারও কেউ নেই। পায়খানা ফেরার ভয়ে দিন রাতে মাত্র একবার খান। মাঝে-মধ্যে খুব বেশি ক্ষুধা পেলে বিস্কুট আর চা খেয়ে নেন। হুইল চেয়ারে নিজের পঙ্গুদেহ টেনে বেড়ানোর শক্তি নেই। ফলে আশপাশে ভিক্ষে করেন। শুক্রবারে শুক্রবারে মসজিদের সামনে উপস্থিত হন। কোথাও খানাপিনার কথা শুনতে পেলে ছুটে যান। সারাদিন ভিক্ষে করে সন্ধ্যায় ফেরেন ক্লাব নামের কুঁডেঘরে। জীবন এখন ভীষণ বোঝা!

এহেন শারীরিক প্রতিবন্ধী জুলমত আলী ভিক্ষে করতে করতে গত বৃহস্পতিবার আলমডাঙ্গা স্টেশন রোডের একটি ওষধের দোকানে যায় ওষুধ কিনতে। সেখানে তার সাথে পরিচয়। বর্তমানে সারা দেশের মত আলমডাঙ্গায়ও ভিক্ষুকদের কল্যাণে সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তার কষ্ট আর থাকবে না। এমন আশ্বাসপূর্ণ কথায়ও জুলমত আলীর ভেতর কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। শেষে ভিজিডির কার্ড আছে কি-না জিজ্ঞেস করলে তিনি পাননি বলে জানান। বলেন, বছরে শুধু প্রতিবন্ধী ভাতা পান ১৫শ টাকা। আর কিছু না। শুধুমাত্র এইটুকুই। এই সময় ১০ টাকার চাল নিয়ে দেশিজুড়ে নানা তেলেসমাতি, অনেকের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার গল্প শুরু হল ফার্মেসিতে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে। জুলমত আলীর এ গল্পে যোগ দেয়ার বিলাসিতা নেই। এতোক্ষণ শুনছিলেন তিনি। গল্প একটু মিইয়ে এলে তিনি মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন ১০ টাকার চালের কার্ড কারা দেয়?

অসহায় প্রতিবন্ধী জুলমত আলীকে ১০ টাকার চালের কার্ড দেয়ার প্রতিশ্রুতি উপস্থিত কেউ দিতে পারেনি। বিড়বিড় করতে করতে ফার্মেসি থেকে হুইল চেয়ারের সাহায্যে বের হয়ে গেলেন তিনি। নিজেকে টেনে টেনে বয়ে নিয়ে অবশেষে রাস্তায় নামলেন। এক সময় চোখের আড়াল হলেন তিনি। কিন্তু তাকে ভুলতে অনেক সময় লেগেছে আমাদের। বার বার মনে প্রশ্ন জেগেছে- এই শারীরিক প্রতিবন্ধীর বেঁচে থাকার সংগ্রামে রাষ্ট্রের সামান্যতম সহানুভূতি ও কি তার কপালে জুটবে না? এটাই হয়তো জুলমত আলীদের অমোঘ নিয়তি! তারপরও তিনি তো আর কবি মোহাম্মদ রফিকের মত কখনো বলতে পারবেন না ভাত দে হারামজাদা/তা না হলে মানচিত্র খাবো।