একই কায়দায় এবার ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধা খুন

স্টাফ রিপোর্টার: মোটরসাইকেলে এসে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে কুড়িগ্রামে। এবার হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণকারী এক মুক্তিযোদ্ধা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে কুড়িগ্রাম পৌরসভার গাড়িয়ালপাড়ায় বাড়ির সামনের রাস্তায় হোসেন আলীকে (৬৮) গলাকেটে খুন করেছে ৩ মোটরসাইকেল আরোহী। ৪ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে হাতবোমা ফাটিয়ে হামলাকারীরা পালিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। গত বছর রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যা, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা, ঢাকার আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে পুলিশ হত্যা এবং পঞ্চগড়ে পুরোহিত হত্যাকাণ্ডেও মোটরসাইকেল আরোহী তিনজন ছিলো বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলো। সকালে ওই হত্যাকাণ্ডের পর কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ, জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিনসহ প্রশাসনের লোকজন ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করেন। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সন্দেহভাজন তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। পুলিশ বলছে, ধর্মান্তরিত হওয়া বা জমিজমার বিরোধে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিদিনের মতো সকালে হাঁটাহাঁটিতে বেরিয়েছিলেন হোসেন আলী। বাড়ি থেকে প্রায় আড়াইশ গজ দূরে আশরাফিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন কুড়িগ্রাম-জিগামারী ঘাট পাকা সড়কে হাঁটছিলেন তিনি। ওই সময় রাস্তায় লোকজন কম ছিলো। হঠাৎ কুড়িগ্রাম শহরের দাদা মোড় হয়ে একটি মোটরসাইকেল তার পাশে এসে দাঁড়ায়। মোটরসাইকেলে ৩ আরোহীর মধ্যে দুজনের মাথায় হেলমেট ছিলো। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হেলমেট পরিহিত ২ যুবক ‘আল্লাহু আকবর’ বলে হোসেন আলীর গলায় কোপ দেয়। এতে তার গলার বেশিরভাগ কেটে যায়। এরপর তিনি রাস্তার ওপর পড়ে যান।

মৃত্যু নিশ্চিত করে হত্যাকারীরা আশরাফিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে তালতলা এবং কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পেছনের রাস্তা হয়ে শহরের ভেতরে ঢুকে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শী আবদার হোসেন ও নয়ন জানান, কালো রঙের ১৩৫ সিসি একটি ডিসকভার মোটরসাইকেলে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৩ যুবক ৪/৫ মিনিটের মধ্যে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

অপর প্রত্যক্ষদর্শী একটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী ফারুক জানান, হত্যাকারীরা প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় কনফিডেন্স কোচিং সেন্টারের এক শিক্ষককে (নাম জানা যায়নি) লক্ষ্য করে একটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। যাওয়ার সময় হামলাকারীরা কলেজপাড়ার তালতলায় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সফিকুল ইসলাম সাকিবের বাড়ির ফটকের সামনে ছাত্রাবাসের ছেলেরা পথ রোধ করার চেষ্টা করলে তাদের লক্ষ্য করে আরও দুটি হাতবোমা ছোড়ে এবং দুটি বড় ছোরা উঁচিয়ে ভয় দেখায় বলে জানান ফারুক। তবে হাতবোমা দুটি বিস্ফোরিত হয়নি বলে জানান তিনি।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু জানান, মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়নের চর সিতাইঝাড় এলাকার মৃত ছেপাত উল্লাহর ছেলে। তিনি পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক হিসেবে গত বছর অবসরে যান। ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি শহরের গাড়িয়াল পাড়ায় নিজ বাড়িতে বসবাস করছিলেন। কর্মস্থল, বন্ধুবান্ধব এবং এলাকাবাসীর কাছে ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন।

কুড়িগ্রাম জেলার পাদ্রী (খ্রিস্টান ধর্মযাজক) রেভারেন্ট ফোরকান আল মসিহ জানান, হোসেন আলী ১৯৯৯ সালে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। সম্প্রতি তিনি তার সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। এলাকায় কারও সাথে তার কখনোই মনোমালিন্য হয়নি।

হোসেন আলীর ছেলে রাহুল আমিন আজাদ জানান, তার পিতা কোনো দরকার ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতেন না। বাড়িতেই তিনি ধর্মচর্চা করতেন। তার ধর্মান্তরিত হওয়া আমার বড় বোন হাসিনা বেগম মেনে নেয়নি। মা, আমি ও ছোট বোন নাসিমা মেনে নিয়ে বাবার পক্ষে ছিলাম। গ্রামের বাড়িতে জমিজমা নিয়ে তাদের প্রতিবেশীদের সাথে বিরোধ রয়েছে বলেও জানান আজাদ। তিনি বলেন, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে আবুল বাশির (২৫) নামে এক যুবক তাদের বাড়িতে ভাড়ায় উঠেছিলো।

আজ (মঙ্গলবার) পরিবার নিয়ে আসবে বলে গত শনিবার চলে যায়। তার দেয়া ন্যাশনাল আইডি ও মোবাইলফোন নম্বর সঠিক নয়। তার বাড়ি রংপুরের মাহিগঞ্জে এবং তিনি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় নেক্সেস ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি করেন বলে জানিয়েছিলেন।

কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার তবারক উল্লাহ বলেন, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর আতঙ্ক ছড়াতে হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। তাদের ছোড়া ককটেলগুলোর মধ্যে দুটি  অবিস্ফোরিত রয়েছে। আমারা রংপুর সেনাবাহিনীর কাছে খবর পাঠিয়েছি, বিশেষজ্ঞ দল এসে ককটেলগুলো নিষ্ক্রিয় করবে। হত্যাকাণ্ড উগ্রপন্থিরা ঘটিয়েছে নাকি পারিবারিক শত্রুতার কারণে হয়েছে তা আমরা খতিয়ে দেখছি।

সন্দেহভাজন তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জানিয়ে এসপি বলেন, তদন্তের স্বার্থে এর বেশি বলা সম্ভব নয়। মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ওই সভায় এখন থেকে কুড়িগ্রাম পৌর এলাকায় সব ভাড়াটিয়ার ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিসহ জীবনবৃত্তান্ত পুলিশের কাছে সংগ্রহে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া জেলাব্যাপী মোটরসাইকেল তল্লাশি জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়।

কুড়িগ্রাম সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রুহানী জানান, এ হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। নিহতের ছেলে রাহুল আমিন আজাদ মামলা করবেন। ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হোসেন আলীর মৃত্যু হয়েছে বলে সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।