ইতিহাস উন্মোচিত হলে ঘটবে আর্থসামাজিক উন্নয়ন

চুয়াডাঙ্গা জেলায় রয়েছে বিভিন্ন যুগের বহু প্রত্নতাত্মিক প্রাচীন নিদর্শন

নজরুল ইসলাম: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ। যেখানে রয়েছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। এছাড়া রয়েছে সম্ভাবনাময় আরও বহু পর্যটন স্পট। সমপোযোগী ও পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এসব পর্যটন স্পট যদি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায় তাহলে পর্যটন শিল্পে নবদিগন্তের সূচনা হবে। পর্যটন বলতে শুধু ঘোরা-ফেরার ধারণা পরিবর্তন করে একে বহুমুখী করার চেষ্টা করতে হবে। আবার ভূগর্ভস্থে লুকায়িত নিদর্শন আবিষ্কারের মাধ্যমে স্থানটিতে যাদুঘর এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থান হবে অনেকের। ফলে কিছুটা হলে বেকার সমস্যা লাঘব হবে। চুয়াডাঙ্গা জেলায় পূরাকির্তীর নিদর্শন খুজে পাওয়া না গেলেও প্রত্নতত্ববিদদের অনুসন্ধানে জেলার কালুপোল গ্রামে গন্ধোপ রায় রাজার ভিটায় সন্ধান মিলেছে পূরাকির্তীর। নতুন করে আশার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে জেলাবাসী। শুধু রাজার ভিটাই না জেলাতে নানা যুগের ১০৪টি প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। সম্প্রতি প্রত্নতত্ব জরিপে তা উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। আর সেটা করতে পারলে চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস যেমন হবে পূর্ণঃগঠন তেমনই আর্থসামাজিক উন্নয়নে সৃষ্টি হবে নতুন দিগন্তের। এর জন্য দরকার সর্বমহলের সন্মিলিত উদ্যোগ।
বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার একটি ক্ষুদ্রায়তন এবং উন্নয়নশীল দেশ। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এর কিছু কিছু অংশে মানব বসতির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ অংশের জনসমাজ বেশ প্রাচীন হলেও কোনো পৃথক সভ্যতার জন্ম দিতে পারেনি। তবে অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট সংস্কৃতি হিসেবে টিকেছিল যুগে যুগে। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ প্রাচীন ইতিহাসের কোনো পর্যায়ই সম্পূর্ণ স্বাধীন ও একতাবদ্ধভাবে আপন রাষ্ট্র গড়ে উঠতে না পারলেও ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করে। তবে অনেক বিদ্রোহের জন্ম হয়েছে এই অঞ্চলে। দেশটির তিনদিক বর্তমানে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং একদিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। প্রাগৈতিহাসিককালে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলই এই বঙ্গোপসাগরের নিচে চাপা পড়েছিলো। বাংলাদেশের মূল অংশ সাগরের কোল থেকেই জেগে উঠেছে। ইংরেজ শাসন আমলে দেশের বিভিন্ন জেলায় জরিপ চালিয়ে ঐতিহাসিক স্থান এবং নিদর্শন চিহ্নিত করা হলেও সে জরিপ থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলার নাম বাদ পড়ে যায়। নানা কারণে বিভিন্ন জেলার খ্যাতি রয়েছে। কোনো জেলা রাজনৈতিক, শৈল্পিক, সংস্কৃতি, তীর্থস্থান, ঐতিহাসিক নিদর্শন অথবা মহান ব্যক্তিদের পদচারণায় হয়ে আছে মহিমান্বিত। যার কারণে দেশজুড়ে সে জেলা পেয়েছে পরিচিতি। স্থাপনা আর নানা নিদর্শন নিয়ে গৌরববোধ করে সে জেলার মানুষ। চুয়াডাঙ্গা জেলায় দর্শণার্থী স্থান তেমন না থাকায় সেদিক থেকে জেলাটি রয়েছে অনেক পিছিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের প্রথম রাজধানী ঘোষণা করা হয় এ জেলাকে। ইতিহাস ঐতিহ্যম-িত এ জেলাটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্র হিসেবে তেমনভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। জেলাতে নানা যুগের ১০৪টি প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। সম্প্রতি প্রতœতত্ব জরিপে তা উন্মোচিত হতে যাচ্ছে।
তারই আলোকে ইতিহাস সমৃদ্ধ চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রতœতত্ব ও ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কারে জরিপ শুরু হয়। এ জরিপে চুয়াডাঙ্গা জেলার ২২৫টি গ্রামের ১০৪টি প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন চিহ্নিত করেন। যার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদরে রয়েছে ৫৯টি, জীবননগর উপজেলায় ১৫টি, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ২১টি ও দামুড়হুদা উপজেলায় ৯টি। জরিপ থেকে প্রতœতত্ব অধিদফতর প্রাচীন আবাসিক স্থাপনা ২১টি, মসজিদ ১৯টি, মাজার বা সমাধি ১৯টি, নীলকুঠি ৬টি, মন্দির ৫টি, প্রাচীন জলাশয় ৪টি, অফিস ৪টি, রেলস্টেশন ৪টি, স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩টি, প্রতœঢিবি ৩টি, কাচারীবাড়ি বা তহশিলখানা ২টি, কবর ২টি, রেলসেতু ২টি, প্রাচীন পাতকুয়া ২টি, গীর্জা ১টি, পার্ক ১টি, ঈদগাহ ১টি, শিল্প স্থাপনা ১টি, বিশ্রামাগার ১টি, তোরণ ১টি। দেশ বিভাগের পূর্বে চুয়াডাঙ্গা জেলা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার অর্ন্তগত ছিলো। পূর্বে এটি বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার অর্ন্তগত ছিলো। তৎকালীন বৃট্রিশ শাসনামলে নদীয়া জেলার অর্ন্তগত কুষ্টিয়া জেলার জন্ম হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে মানচিত্রে জায়গা পায়। চুয়াডাঙ্গা আয়তনে ৫৪তম বৃহত্তর জেলা। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে সর্বপ্রথম চুয়াডাঙ্গাকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ঘোষণা করা হয়। নিরাপত্তা এবং কৌশলগত কারণে পরবর্তীতে চুয়াডাঙ্গা থেকে রাজধানী মুজিবনগরে সরিয়ে নেয়া হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে জেলাতে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় শতাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধকালীন গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পেছনে, দামুড়হুদার নাটুদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে তিনটি গণকবর, হৈবতপুরে, জীবননগরে সীমান্তবর্তী ধোপাখালি গ্রামে এবং আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ ক্যানালের তীরবর্তী স্থানে যুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতিস্তম্ভ। জেলায় রয়েছে নবগঙ্গা নদী, চিত্রা নদী, ভৈরব নদ, কুমার নদ, মাথাভাঙ্গা নদী। যদিও কালের আবর্তে সবগুলো নদী আজ মৃত প্রায়। দর্শণীয় স্থানের মধ্যে আছে জীবননগরের দত্তনগর কৃষি খামার, দামুড়হুদার নাটুদহের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর, দর্শনা কেরুজ চিনিকল, ডিস্টিলারী কারখানা, হাজারদুয়ারি স্কুল, কার্পাসডাঙ্গার নীলকুঠি, আলমডাঙ্গার ঘোলদাড়ি ওমর শাহ’র মসজিদ, তিয়রবিলা বাদশাহী মসজিদ, চুয়াডাঙ্গা সদরের গড়াইটুপিতে সাধক হযরত খাজা মালিক উল গাউস (রঃ) মাজার, চারুলিয়ার মেহমান শাহরের মাজার, জমিদার নফর পালের প্রাকৃতিক শোভাবর্ধনকারী তালসারি সড়কসহ বিভিন্ন স্থান।
চুয়াডাঙ্গার ইতিহাস পূর্ণঃগঠনে প্রতœতত্ব অধিদফতরর ১০৪টি নিদর্শনের মধ্যে ২টি স্থানকে চিহ্নিত করে খননের কাজ শুরু করেছে। তার মধ্যে রয়েছে দামুড়হুদার চারুলিয়া মেহমান শাহ’র মাজার সংলগ্ন ঢিবি এবং চুয়াডাঙ্গা সদরের কালুপোল গন্ধর্প রায়ের রাজার ভিটা। রাজার ভিটা এবং চারুলিয়া ঢিবি খনন করে বেশকিছু প্রাচীন পূরাকির্তী পাওয়া গেছে। খননের কাজ শেষ হলে সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র ও জাদুঘর। ইতোমধ্যে কালুপোল রাজার ভিটায় যাদুঘর নির্মাণের জন্য স্থানীয়রা জমিও দিয়েছেন। যাতায়াতের জন্য রাস্তা আর বাতি জ্বালানোর জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অপরদিকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় পর্যটন শিল্পের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে তা কালের পরিক্রমায় আজ বহুদূর এগিয়েছে। মনমানসিকতার পরিবর্তন, অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং প্রো-অ্যাক্টিভ কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে কালুপোলের পর্যটন শিল্প বহুদূর এগিয়ে যাবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থন সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হয়ে দরিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে সমৃদ্ধ জেলা গড়া সম্ভব হবে। পর্যটন শিল্পের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের জন্য যদি অনুকূল পরিবেশ মিলেমিশে একত্রে কাজ করা যায়, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।