আলোর মুখ খুঁজছে জ্বালানিবিহীন ইঞ্জিন এবং সভ্যতার আর এক মাত্রা

 

মাজেদুল হক মানিক: যখন কোন স্বয়ংক্রিয় ইঞ্জিন ছিলো না, মানুষ নিজেই অথবা ভারবাহী পশু ছিলো পরিবহন ব্যবস্থার উপায়। এর পর চাকা আবিষ্কার হলো। পরিবহন ব্যবস্থায় সামর্থ অনেক গুণ বেড়ে গেলো। সভ্যতা চাকায় আরোহণ করলো। এরপর আবিষ্কার হলো বাষ্পীয় ইঞ্জিন। কয়লার জ্বালানিতে বাষ্পীয় ইঞ্জিন সভ্যতার পথ চলায় দিল প্লৈবিক গতি। তারপর আবিষ্কার হলো কম্বচশন ইঞ্জিন। সভ্যতা পেলো আধুনিক মাত্রা। পাশাপাশি কালো ধোঁয়ার অবগুণ্ঠনে ঢেঁকে ধেয়ে এলো সর্বগ্রাসী বৈশ্বিক উষ্ণতার করাল গ্রাস। এই কালো ধোঁয়ার ভয়াল ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে পৃথিবীব্যাপী ছয়শত কোটি মানুষের টিকে থাকা এক বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। মানুষের মুখে অন্ন, গায়ে বস্ত্র, মাথার ওপর আশ্রয়, অসুস্থতায় চিকিৎসা আর বেঁচে থাকার উপায়-উপকরণ তৈরি, পরিবহনের জন্য ধোঁয়া ও উত্তাপমুক্ত নির্দোষ শক্তি অন্বেষণ আজকে মানুষের জন্য অতি জরুরি প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি। এসব বিষয় নিয়ে দেশে দেশে উদ্বেগ বিরাজ করছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি, ক্ষমতা ও আধিপত্যের জন্য জ্বালানি এক অপরিহার্য বিষয় হয়ে উঠেছে। যারা জ্বালানি ও শক্তি সম্পদে যতো বেশি সমদ্ধিশালী, তারাই আগামীতে নেতৃত্বে টিকে থাকবে- এমন কথাও শোনা যায় বিভিন্ন মহল থেকে। আশার কথা হচ্ছে- এখন আমরা আর শুধুমাত্র দর্শক-শ্রোতা থাকছি না। কারণ দূর কোনো দেশ নয়, এবার খোদ আমাদের দেশেরই একজন এমন এক ইঞ্জিনের ফর্মূলা আবিষ্কার করেছেন যা দেশ-বিদেশের জ্বালানি কৌশলে আনবে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মেহেরপুর গাংনী পৌরসভার অধীন চৌগাছা গ্রামের শেখ মুহা. মাওয়াফীকুল ইসলামের গবেষণা কর্মের ফল হিসেবে ধরা দিয়েছে অসাধ্য সেই জ্বালানিবিহীন ইঞ্জিনের একটি মডেল। এই ইঞ্জিন যোগাযোগ-যাতায়াত ও বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে বিশ্ববাসী। এতে জ্বালানি সাশ্রয়, আমদানি ও ভর্তুকি খাতে চাপ কমিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আসবে এক অভাবনীয় সাফল্য।

এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, তিনি ইঞ্জিনের দুটি ফর্মূলা আবিষ্কার করেছেন। তার আবিষ্কৃত ইঞ্জিন অভিকর্ষ শক্তিতে চালিত হবে। এই ইঞ্জিন চালানোর জন্য কোনো জ্বালানি ব্যবহার করা হবে না। এর সাহায্যে ছোট-বড় সব জলযান, রেল ও বিদ্যুত উৎপাদনকারী জেনারেটর চালানো যাবে। এর মধ্যে তিনি ডিজাইন ও প্রকল্পপত্র চূড়ান্ত করেছেন। তিনি অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ে নির্মাণযোগ্য একটি মডেলও তৈরি করেছেন। ইঞ্জিনটিকে সড়ক পথে চালানোর উপযোগী করার জন্য কাজ করছেন। নিয়ম ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন এবং ইঞ্জিনের প্রক্রিয়ার যৌক্তিক বিশুদ্ধতা ও গাণিতিক সঠিকতা প্রমাণ করেছেন। তিনি জানান, সব ঠিক থাকলেও ইঞ্জিনকে কার্যকরী হতে যান্ত্রিক বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এর জন্য পর্যাপ্ত সামর্থ আর যথাযথ দক্ষ মেশিন-টুলস ফ্যাক্টরীতে কাজ করা প্রয়োজন।

গবেষণার বিষয়ে তিনি বলেন, ৫০ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট চওড়া একটি জায়াগার মধ্যে ইঞ্জিনটি জ্বালানী ছাড়াই ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারবে। ছোট ছোট আঞ্চলিক এককে বিদ্যুত উৎপাদন প্ল্যান্ট বসানো গেলে প্রতিটি অঞ্চল বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। এবং এই বিদ্যুৎ কখনও যাবে না। অর্থাৎ পর্যাপ্ত চাহিদা পূরণ করেও লোডশেডিং হবে না। তিনি বলেন, অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহারে সারাবিশ্ব আজ হুমকির মুখে। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে জলবায়ুর মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। এ হুমকী মোকাবেলায় এবার বাংলাদেশ বিশ্বকে একটি সত্যিকারের অর্থবহ পদক্ষেপ উপহার দিতে পারবে। তার ইঞ্জিন যখন ধোঁয়া, উত্তাপ ও রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া উৎপাদনকারী জ্বালানিকে প্রতিস্থাপন করবে তখন সভ্যতা নতুন জীবন লাভ করবে। জ্বালানিবিহীন এই ইঞ্জিন পরিবেশ সুরক্ষা ও সভ্যতার এগিয়ে চলার পথে হবে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক হতে পারে। এই আবিষ্কারের পেটেন্ট নিশ্চিত করে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী ২২ বছর এই ইঞ্জিনের একমাত্র উৎপাদনকারী ও পরিবেশক হিসেবে ভূমিকা রাখার গৌরব অর্জন করবে।

অপরদিকে আমাদের দেশের প্রতিটি একক অঞ্চল বিদ্যুতে স্বয়ং সম্পূর্ণ হলে মাঠে মাঠে পর্যাপ্ত পরিমাণ কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের মাধ্যমে অতি স্বল্পমূল্যে কৃষিপণ্য সংরক্ষণ করতে সমর্থ হবে। কৃষি ক্ষেত্রে ঘটবে এক মহান বিপ্লব। তাতে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের অপচয় রোধ হবে। কৃষক লাভ করবে নিরাপত্তা ও ন্যায্যমূল্য পাওয়ার আত্মনিয়ন্ত্রিত শক্তি। এতে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং রফতানি খাতে কৃষিও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। এর মধ্য দিয়ে দেশের কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হবে এবং আয়ও বাড়বে।

শেখ মুহা. মাওয়াফীকুল ইসলাম চৌগাছা গ্রামের নিফাজ উদ্দীন শেখ ও মোছা. নিহারন নেছার ছেলে। ১৯৯১ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন থেকেই বিজ্ঞান গবেষণায় তিনি অতি উৎসাহী ছিলেন। বিজ্ঞানের একেকটি বিষয় পড়তে গিয়ে নতুন নতুন প্রশ্নের আবর্তে বারবার গভীর ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে পড়তেন। তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সাইফন সিস্টেমের মধ্যে যান্ত্রিক কৌশল আরোপ করে অন্য কোনো এজেন্ট ব্যবহার না করেই পানিকে নিচের স্তর থেকে ওপরে নেয়ার প্রযুক্তি তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এটা তার বিজ্ঞান বিষয়ক আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম।