অধ্যাপক ডা. রাজিবুল নামমাত্র ফি নিয়ে চিকিৎসা দেন এলাকাবাসীর

বেগমপুর প্রতিনিধি: দেশ জাতি ও মানুষের সেবায় যারা নিজেকে উৎস্বর্গ করেছেন তারই বেঁচে থাকে অনন্তকাল। কর্মসৃষ্টি বাঁচিয়ে রাখে একজন কৃর্তিমান মানুষকে। অনেকেই মানুষের অবদান ভুলে গিয়ে ছোটেন অর্থের পেছনে। আবার অনেকেই মানুষকে ভালোবেসে নিজেকে বিলিয়ে দেন মানব সেবায়। অনেক পেশায় মানব সেবা করার তেমন সুযোগ থাকে না। তবে চিকিৎসা বড় মাপের পেশা। তাদের মতো মহৎ কাজ করার সুযোগ অন্য কোনো পেশার মানুষ পায় কি না; সন্দেহ আছে। সামান্য মাথাব্যথা থেকে শুরু করে যেকোনো অসুখ-বিসুখে মানুষ ডাক্তারের কাছে ছুটে যান। ডাক্তারের মুখের কথার ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। ডাক্তাররা সমাজের সেবক, মানুষের সেবক। নামকা ওয়স্তে ফি নিয়ে গ্রামের মানুষকে নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. রাজিবুল ইসলাম রাজু। তিনি সপ্তায় ২দিন চুয়াডাঙ্গার হিজলগাড়ি বাজারে অবস্থিত রহিমন নেছা ডায়াগনস্টিক এ- সনো সেন্টারে বসে এ সেবা দিয়ে থাকেন। অর্থবিত্তকে গুরুত্ব না দিয়ে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় সাধ্যমতো সেবা দিতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন ডা. রাজিবুল ইসলাম। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের কষ্টলাঘবে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি ছুটে আসেন গ্রামে।
মানুষ সৃষ্টিকর্তার পর যদি কারোর ওপর বিশ^াস রাখতে চাই; সে হলো ডাক্তার। কারণ প্রতিটি মানুষের নিকট তার জীবন সবচেয়ে মূল্যবান। ডাক্তারি পেশা একটি সেবামূলক ও সম্মানি পেশা, তবে অধিকাংশ ডাক্তারদের খাম খেয়ালীপনায় আজকাল জনসাধারণ ডাক্তারদের সেই প্রাপ্য সম্মান টুকু দেয় না। বরং জনসাধারণ কথায় কথায় ডাক্তারদের কসাই/ডাকাত বলে সম্বোধন করেন। তবে এজন্য জনসাধারণ দায়ী নয় দায়ী সেই ডাক্তাররাই। কারণ তারা তাদের কাজকর্মে তাদের সম্মানটুকু ধরে রাখতে পারেনি। অধিকাংশ ডাক্তার তাদের লোভ লালসায় নিজের আত্মসম্মান বির্সজন দিলেও মানবতার সেবক হিসেবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবগঠিত নেহালপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামের ডা. রাজিবুল ইসলাম রাজু। সাপ্তাহে দুদিন হিজলগাড়ি বাজারে অবস্থিত রহিমন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসে এলাকার মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা, বড়সলুয়া গ্রামের আহারন, বলদিয়া গ্রামের ছবেদা, ছোটসলুয়া গ্রামের মমতাজ, বেগমপুর গ্রামের মনিরা, ঝাঝরি গ্রামের সুখি খাতুন, যদুপুর গ্রামের রমেলা, নেহালপুর গ্রামের ছবিরন, ডিহি গ্রামের মালেকাসহ উপস্থিত অনেকেই জানালেন, হিজলগাড়ি বাজার থেকে চুয়াডাঙ্গা ১৩ কি.মি., দর্শনা ৮ কি.মি. পথ। যেখানে যাতায়াতের একটি খরচ আছে। অথচ নির্ধারিত দিনে বাড়ির কাজ সেরে মাত্র ৫০ টাকা ফি দিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি। এটা আমাদের কাছে অনেক পাওয়া। বিশেষ করে বর্তমান বাজারে গর্ভবতী মায়েরা এতো অল্প খরচে হাতের কাছে সেবা পাবে ভাবতেই পারছি না। আবার অনেকেই গরিব অসহায় নারীরা টাকা বাদেই ফ্রি-তে চিকিৎসা নিয়ে যাচ্ছেন। টাকার কারণে কেউ চিকিৎসা পাননি এমনটি কখনও শুনিনি। ডা. রাজিবুল ইসলাম চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবগঠিত নেহালপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামের পল্লীচিকিৎসক মৃত আব্দুল মজিদ ও পরিবার কল্যাণ সহকারী জিনাত রেহেনার বড় ছেলে। তিনি ১৯৯৭ সালে হিজলগাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯৯ সালে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০০৬ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করেন। পরে সরকারি ডাক্তার হয়ে প্রথম ডাক্তারি পেশা শুরু করেন আলমডাঙ্গা হারদী হাসপাতালে। পরবর্তীতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার এবং আরএমও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ রংপুর মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। ডা. রাজিবুল ইসলাম বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে সৈয়দপুর রেলস্টেশন ৪৫ কি.মি. দূর। গ্রামের মানুষের সেবা দেবার জন্য স্টেশনের কাছে বাসাভাড়া করে থাকি। যাতে সময়মত ট্রেন ধরে গ্রামে এসে মানুষের সেবা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারি। বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিলো আমি ডাক্তার হবো। ডাক্তার হয়ে আমার মা-বাবার মতো মানুষের সেবা করবো। আমি এখানে না আসলেও পারি। কর্মস্থলের আসপাশে ৫শ টাকা ফি নিয়ে অহরহ চিকিৎসা দিতে পারি। ছোটবেলা থেকেই টাকার প্রতি আমার মোহ ছিলো না। এখনও নেই। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না। তাই যতোটুকু প্রয়োজন সেটুকু করি। আর বাকি সময়টুকু মানুষের সেবা করে যায়। গরিব দুখি মানুষের সেবা করার মধ্যে যে আত্মিক শান্তি তা টাকা দিয়ে পরিমাপ হয় না। যতোদিন বেঁচে আছি মানুষের সেবা করে যেতে চাই। কারণ এ পেশায় বিত্তবান হবার সুযোগ যতেষ্ট আছে। তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা একটি মহান পেশা। তাই রোগীর বিশ^াস স্থাপনের জন্য মাত্র ৫০ টাকা ফি নেয়া হয়। নিজেকে প্রকাশ করার এবং জীবনে বেঁচে থাকার অনেক পেশা আছে। সবচে মহান পেশা, উৎকৃষ্ট পেশা, চিকিৎসা সেবা। এই পেশায় মানুষের কাছে যাওয়া, তাদের সেবা করার সুযোগ আছে। মানুষ যখন রোগাক্রান্ত হয়, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে, তখন চিকিৎসার মাধ্যমেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায়, আর তা চিকিৎসকের ওছিলায় আরোগ্য হয়। অসুস্থ অবস্থায় মানুষ অসহায় দুর্বল থাকে। এই দুর্বল সময় চিকিৎসকই তার বড় অবলম্বন, বড় বন্ধু, অসহায়ের সহায়। এজন্যই চিকিৎসা সেবা মহান পেশা হিসেবে গণ্য। আর সে পেশাটিই বেঁচে নিয়েছি। এ যাবত প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা দিয়েছি। যতো দূরেই থাকি না কেন গ্রামের মানুষের টানে ছুটে আসি। যতোদিন বেঁচে আছি আসব। কারণ আমার বড় হবার পেছনে এলাকাবাসীর রয়েছে অবদান।
এলাকাবাসী জানায়, ডাক্তারি একটি মহান পেশা এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ডাক্তারদের জন্য যখন কারও বড় কোনো ক্ষতি হয়; তখন কষ্ট লাগে। টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য মৃত মানুষকে আইসিইউতে রাখার ঘটনা আমাদের দেশে হরহামেশাই দেখা যায়। টাকা হাতানোর উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনীয় অপারেশন করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ওষুধ কো¤পানির কাছ থেকে কমিশন পাওয়ার জন্য বেশি বেশি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন অনেক ডাক্তারা। বেশি রোগী দেখার উদ্দেশে রোগীদের পর্যাপ্ত সময় না দেয়াটা কা-জ্ঞানহীন ও অমানবিক হলেও তা অহরহ ঘটছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কাছ থেকেও উপরি পাওয়ার জন্য বিনাকারণে অসংখ্য টেস্ট ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশে বহু ভালো চিকিৎসক রয়েছেন, যারা দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু দুষ্টু প্রকৃতির ডাক্তারের জন্য মহৎ এ পেশা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, যা মেনে নেয়া কষ্টকর। ডাক্তারির মতো মানবিক ও মহৎ পেশাকে অনেকেই কলুষিত করছে। বিত্তবান হবার যতেষ্ট সুযোগ থাকলেও ডা. রাজিবুল ইসলাম অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। তা না হলে মূল্যবান সময় নষ্ট করে প্রতিসপ্তাহে রংপুর থেকে হিজলগাড়িতে ছুটে আসেন। তার এ নামমাত্র ৫০ টাকা ফি নিয়ে চিকিৎসা দেয়ার বিষয়টি সেবা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। তাই তো রাজিবুল ইসলাম এলকাার মানুষের নিকট মানবতার ডাক্তার না সেবক।