বাবা-মা’র সাথে দূরত্বই ঐশীকে বিপথে নেয়

স্টাফ রিপোর্টার: শুধু ইয়াবা, গাঁজা, বয়ফ্রেন্ড আর ডিজে-ড্যান্ড পার্টিতে অংশ নেয়ার কারণে ঐশী বিপথে যায়নি। বাবা-মায়ের সাথে তার বিশাল মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো। বাবাকে সে সেকালের মানুষ মনে করতো। আর মায়ের অপরাধ বাবাকে সব কিছু বলার পাশাপাশি বেশি শাসন করতেন। কিন্তু বাবা-মা তার কোনো কথাই শুনতে চাইতেন না। এভাবেই দিনের পর দিন চলার কারণে ঐশী বাবা-মাকে খুনের মতো অপরাধ করতেও দ্বিধা করেনি। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবারের সাথে সন্তানদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হলে তারা যেকোনো ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

গতকাল সোমবার পর্যন্ত তদন্ত করে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে হত্যাকাণ্ডে একটি ছুরিই (খঞ্জর) ব্যবহৃত হয়েছে। আর একটি বটি ব্যবহার করা হয়েছে শুধুমাত্র স্বপ্না রহমানের কোমর থেকে চাবির গোছা কাটতে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা- সিআইডির ক্রাইম সিনের পরীক্ষায় দুটি ধারালো অস্ত্রেই একজনের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। সিআইডির একজন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ঘটনাস্থলে যে কজনই উপস্থিত থাক না কেন হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে একজন। গত রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত তদন্তে ঐশীই একমাত্র খুনি বলে নিশ্চিত হয়েছিলো তদন্তকারীরা। কিন্তু গত রোববার রাতে ঐশীর হঠাত দেয়া এক বক্তব্য তদন্তকারীদের এলোমেলো করে দিয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী জানায়, বাবা-মাকে হত্যা সে করেনি। করেছে তার দু বন্ধু জনি ও সাইদুল। সন্ধ্যা ৭টার দিকে সে নাইটাস নামে ১০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে কফি তৈরি করে। তার এককাপ সে তখনই মাকে খেতে দেয়। কফি খাওয়ার পর মা গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে গেলে তার দু বন্ধু জনি ও সাইদুল প্রাইভেটকার নিয়ে তাদের চামেলী ম্যানশনে প্রবেশ করে। তারা সিঁড়ি বেয়ে আটতলা ভবনের সিঁড়িঘরে চলে যায়। রাত সাড়ে ১০টার পর বাবা বাসায় ফেরার পর তাকেও এককাপ কফি খেতে দেয় ঐশী। বাবা তার (ঐশীর) রুমে ঘুমিয়ে পড়ার পর তার দু বন্ধু বাসায় ঢোকে। এরপর তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে যায়। কিন্তু ঐশীর এ বক্তব্যের সপক্ষে কোনো শক্ত যুক্তি সে দেখাতে পারেনি। তাছাড়া এ গল্পটি সে এলোমেলোভাবে বলেছে। দু বন্ধু খুনি হলে তারা কিভাবে এলো, কিভাবেই বা গেল, লাশ গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে সেই বা কেন বাথরুমে নিল তার কোনো জবাব দিতে পারেনি ঐশী। ফলে গোয়েন্দারা তার কথা বিশ্বাস করছেন না। তদন্তকারী একজন কর্মকর্তা বলেন, সুমি তাদের কাছে বলেছে, বাসায় সে অন্য কাউকে দেখেনি। তাছাড়া আপুর সাথে সেই লাশ বেডশিট পেঁচিয়ে টেনে বাথরুমে নিয়ে যায়। পাশাপাশি দু বন্ধু খুনি হলে হত্যাকাণ্ডে কেন একটি ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। আর সেটিকে কেনই বা একজনের হাতের ছাপ পাওয়া গেলো।

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (গোয়েন্দা) মনিরুল ইসলাম গতকাল বলেন, এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডে মেয়েটির সরাসরি জড়িত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর হত্যাকাণ্ডে একটি অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে বলেও জানান তিনি। আর একটি বটি ব্যবহার হয়েছে শুধুমাত্র স্বপ্নার কোমর থেকে চাবির গোছা কেটে নেয়ার জন্য। দুজন মানুষকে ঐশী একাই কিভাবে হত্যা করলো এমন প্রশ্নের জবাবে- এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দুজন মানুষকে ১০টি শক্তিশালী ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর তারা এমনিতেই অর্ধেক মরার মতো ছিলেন। ফলে তাদের খুন করতে কজন প্রয়োজন তা আপনারাই বুঝতে পারেন?

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ঐশী তাদের কাছে স্বীকার করেছে, তার মায়ের শরীরে সেই প্রথম ছুরিকাঘাত করে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ঐশী যখন বুঝতে পারছে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য তার কঠিন শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) হতে পারে তখন সে এলোমেলো কিছু গল্প বলছে। কিন্তু গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে অনেক সময় সঠিক তথ্যও দিচ্ছে। এক পর্যায়ে ঐশী তাদের জানায়, তার বাবা-মায়ের লাশ টুকরো টুকরো করে ব্যাগে ভরে বাইরে ফেলে দেয়ার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু বাসায় ধারালো কিছু না থাকার কারণে সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে সে। গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত তিনজনের বাইরে পারভেজ নামে ঐশীর প্রেমিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। গোয়েন্দারা জানান, ঐশী খুবই ধুরন্ধর। মাঝে মধ্যে সে গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করতে ইংরেজিতে কথা বলে। তবে বাবা-মায়ের হত্যার জন্য তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। কঠিন জিজ্ঞাসাবাদেও সে অবিচল।

এদিকে বয়স নিয়ে বিতর্কের ঘটনায় তদন্তকারী সংস্থা ঐশীর দাঁত পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পিতা-মাতার খুনি সন্দেহে ঐশীকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে। এরপরই বিভিন্ন মহলে তার বয়স নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ঐশীর চাচা মশিউর রহমান রুবেল গতকাল বলেছেন, ১৯৯৫ সালে খুলনায় ঐশীর জন্ম হয়েছে। তাতে অপরাধ সংগঠনকালে ঐশীর বয়স ১৮ বছর পার হয়েছে। ঐশীর বিদ্যালয় অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের কাছে পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দিতে হয়। সেখানে তার বয়স ১৭ আগস্ট, ১৯৯৬ লেখা রয়েছে। তাতে বয়স ১৭ বছর হয়। তাই বয়স নিয়ে বিতর্কের অবসান করতে পরীক্ষাগারে ঐশীর দাঁত পরীক্ষা করে প্রকৃত বয়স নিরূপণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, জেলা প্রবেশনার কর্মকর্তাকে না জানিয়ে, বয়স যাচাই না করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কাউকে রিমান্ডে নেয়া হলে তা শিশু অধিকার আইনের লঙ্ঘন।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম জানান, মেয়েদের মাদক গ্রহণের পরিমাণ এখন উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। দেশে ৮০ লাখ মাদকাসক্তের ৩০ ভাগই এখন মেয়ে? তাদের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছরের মধ্যে। তিনি বলেন, কেউ মাদকাসক্ত হলে তার চিকিত্সা না করিয়ে আটকে রাখা হলে তার মধ্যে প্রতিহিংসার জন্ম নেয় এবং এই নির্মম ও করুণ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তাই মাদকাসক্ত সন্তানদের চিকিত্সার ওপর জোর দেন তিনি। অপরদিকে মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম হত্যাকাণ্ডে তাদের মেয়ে জড়িত বলে দাবি করা হলেও তা মানতে নারাজ নিহত পুলিশ কর্মকর্তার ভাই মশিউর রহমান রুবেল। জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে পুলিশ জানালেও এ হত্যামামলার বাদী রুবেলের ধারণা, তার ভাই ও ভাবী হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্য কোনো রহস্য রয়েছে। তিনি সোমবার বলেন, বিষয়টি রহস্যজনক। এতো ছোট একটি বাচ্চা কিভাবে তার বাবা-মাকে এভাবে হত্যা করতে পারে। এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।

প্রসঙ্গত গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার চামেলীবাগের একটি ফ্ল্যাট থেকে এসবির ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দু সন্তান ঐশী ও ঐহী এবং গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন তারা। লাশ উদ্ধারের পরদিন পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে ঐশী।