পানি এলে ইলিশও যাবে

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার আশ্বাস দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তবে কবে নাগাদ এ চুক্তি হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। অথচ শিগগিরই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এক সময় তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার মমতার সুর এবার অনেকটাই নরম। ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

প্রায় ১৭ বছর পর এ সফরে ঢাকায় আসা মমতা ব্যানার্জির সাথে প্রধানমন্ত্রীর কুশল বিনিময় হয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেই। একুশের প্রথম প্রহরে দুজনেই গিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। শনিবার গণভবনে দেখা হওয়ার পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছেন। তাদের সাক্ষাৎ ছিল আবেগপ্রবণ ও আন্তরিক। সেখানে বৈঠকও হয়েছে আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে। আলোচনায় তাদের মধ্যে সেই স্বভাবসুলভ রসিকতা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক আলাপে তিস্তার কথা প্রথমে তুলেছেন মমতা ব্যানার্জি নিজেই। শেখ হাসিনা এ সময় মমতাকে একটি নৌকা উপহার দিয়ে বলেন- তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি যেন আসে, নৌকা যেন চলতে পারে। উত্তরে মমতা বলেন, পানি বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পাবে। দু দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখেই পানি বণ্টন হবে। এ ব্যাপারে তার ইতিবাচক ভূমিকা থাকবে। মমতা বলেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন পানির সঠিক ভাগাভাগির ব্যবস্থা হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পদ্মার ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে কম পাওয়া যাচ্ছে। ইলিশ আরও বেশি করে পেতে চায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। জবাবে শেখ হাসিনা মুচকি হেসে তাকে বলেন, বেশি ইলিশ উৎপাদনের জন্যে বেশি পানি দরকার। আমাদের পানি দিন, পানি এলে ইলিশও যাবে। বৈঠক শেষে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন দুজনই। এরপর প্রায় আধা ঘণ্টা একান্তে কথা বলেন শেখ হাসিনা ও মমতা ব্যানার্জি।

গতকাল শনিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকের পর মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন মমতা ব্যানার্জি। ভোজের আয়োজনে প্রাধান্য ছিলো ইলিশের। ভোজের আগে অনুষ্ঠিত বৈঠকেই বলা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে ভারতের পার্লামেন্ট অধিবেশন। এ অধিবেশনে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হবে। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ সুরক্ষা করে তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার আশ্বাস দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। মমতা ব্যানার্জির কথার ওপর বাংলাদেশ কতোটা আস্থা রাখছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা অবশ্যই আশাবাদী। কেননা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও দ্রুত তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করার কথা বলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রীকে সে রকমের বার্তাই দিয়েছেন। এখন চুক্তি করতে কোনো সমস্যা দেখছি না।

২০১১ সালে গজলডোবায় তিস্তার পানির ২০ শতাংশ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্যে ছেড়ে দিয়ে অবশিষ্ট পানি দুদেশের মধ্যে সমানভাবে (৪০ শতাংশ হারে) ভাগ করে নেয়ার ফর্মুলায় একমত হয়েছিল ঢাকা ও দিল্লি। বিষয়টি মমতা ব্যানার্জিকেও জানিয়েছিল তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরে এসে এই চুক্তিতে সই করবেন বলে চূড়ান্ত হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে চুক্তির বিরোধিতা করে সফরসঙ্গীর তালিকা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন মমতা ব্যানার্জি।

শেখ হাসিনার সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা অনেকেই জানেন। মমতা ব্যানার্জি প্রধানমন্ত্রীকে হাসিনা দি বলে সম্বোধন করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ে উচ্ছ্বসিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রটোকল ভেঙে টেলিফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিস্তা চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে অভিমানী এক দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিলো। মমতা ব্যানার্জির এ সফরে শেখ হাসিনার আন্তরিক আতিথেয়তায় সেই দূরত্ব ঘুচল বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেছেন, মমতা ব্যানার্জি প্রধানমন্ত্রীকে বড় বোনের মতো দেখেন। প্রধানমন্ত্রীও তাকে ছোট বোনের মতো দেখেন।

মমতা ব্যানার্জি অমর একুশে পালনের জন্যে তাকে আমন্ত্রণ জানানোয় ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমি আপ্লুত, আমি ধন্য। মহান একুশের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ আমন্ত্রণ আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। একুশের অনুষ্ঠান দেখার জন্যে মমতার আগ্রহেই তাকে আমন্ত্রণ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আমন্ত্রণপত্র পাঠানোর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনাপত্তি নিয়েছে বাংলাদেশ। মোদি সরকার মমতাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে সানন্দে সম্মতি জানিয়েছে।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিটমহলে বাংলাদেশীদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরলে মমতা বলেন, তিনি নিজেও ওই এলাকা ঘুরে দেখেছেন, দুর্ভোগ দেখেছেন। এ বিবেচনা থেকেই যত দ্রুত সম্ভব সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মত দেন দু নেতা। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পর্কে মমতা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। বাংলাদেশ আমারও দেশ। বাংলাদেশের স্বার্থকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ সংরক্ষণ করেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবো। তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কলকাতায় যে চেয়ার উদ্বোধন হবে এবং কলকাতায় প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ভবন নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পশ্চিমবঙ্গ সফরের আমন্ত্রণ জানান মমতা ব্যানার্জি। প্রধানমন্ত্রী এ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে বলেন, সুবিধামতো সময়ে তিনি অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ সফর করবেন।

মমতা ব্যানার্জি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, তখন তিনি ছোট ছিলেন এবং সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান নিয়মিত শুনতেন। দু বাংলার মধ্যে সম্পর্ক অটুট রাখতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যতো কিছু করা দরকার করবেন বলে আশ্বাস দেন মমতা ব্যানার্জি। দু নেতার মধ্যে ব্যবসায়িক আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ওপরও আলোচনা হয়। একটি যৌথ কমিটি করে দুই বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক উৎসব করার কথা বলেন মমতা ব্যানার্জি। প্রধানমন্ত্রী এতে সায় দেন। এছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের নামে পশ্চিমবঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথাও বলেন তিনি।

মধ্যাহ্নভোজে ইলিশের সমারোহ: বৈঠকের পর গণভবনে মমতা ব্যানার্জির জন্যে দেয়া মধ্যাহ্নভোজে ইলিশের চার পদসহ ১২ পদের আয়োজন ছিলো। ওই ভোজে ছিলেন মমতার সফরসঙ্গীরাও। ইলিশ ভাজা, সর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ এবং ইলিশের ডিম। ছিল চিতল মাছের কোপ্তা, রুই মাছের দো-পেঁয়াজি আর চিংড়ি মাছের কারি। এছাড়া খাসির রেজালা, চিকেন কারি, সবজি, ফলাহার, কুমিল্লার রসমালাই, টক ও মিষ্টি দই এবং চা-কফি। আর সাদা ভাত ছিল কালিজিরা চালের।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চা চক্র: মমতা ব্যানার্জিকে চা চক্রে আপ্যায়িত করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গহর রিজভী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। গতকাল শনিবার বিকালে মমতা ব্যানার্জির সম্মানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় হাইটি নামে চা চক্রের আয়োজন করা হয়। সেটিই ছিলো মমতা ব্যানার্জির ঢাকায় ব্যস্ত সময় কাটানোর পর শেষ অনুষ্ঠান। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বহুদিন পর দু বাংলায় ফিরে আসা উষ্ণতা অনুভব করেছেন সবাই।