চুয়াডাঙ্গায় পোল্ট্রি খামারে ছড়িয়ে পড়েছে বার্ড ফ্লু সাদৃশ্য রোগ

মারা গেছে সহ¯্রাধিক মুরগি : জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের অস্বীকার
ফাইজার চৌধুরী: চুয়াডাঙ্গার বেশ কয়েকটি পোল্ট্রি খামারে অজ্ঞাত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। যা অনেকটা এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা (এআই) বা বার্ড ফ্লুর মতো হলেও গোপন করছেন খামারিরা । চলতি বছরের শুরুতেই খামারগুলোতে বার্ড ফ্লু ধরণের এ রোগ দেখা গিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। আক্রান্ত মুরগি দ্রুত বাজারে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। এতে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা জেলার কোথাও বার্ড ফ্লু বা অন্য কোন রোগের খবর মেলেনি বলে দাবি করেছেন ।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় প্রথম বার্ড ফ্লু সাদৃশ্যে রোগের সন্ধান মেলে পৌর এলাকার শ্মশানপাড়ায় অবস্থিত জোবেদা পোল্ট্রি ফার্মে। চলতি জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে জোবেদা পোল্ট্রির সহ¯্রাধিক মুরগি মারা গেলে তা মাটিতে পুঁতে ফেলে কর্তৃপক্ষ। কিছু মুরগি এলাকাবাসীর মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। বর্তমানে ওই খামারে মুরগির সংখ্যা তিনভাগের একভাগে নেমে এসেছে। তবে, জোবেদা পোল্ট্রি বিষয়টি জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসকে অবহিত করেনি বলে দাবি করেছেন ডিএলও গোলাম মোস্তফা । তিনি জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার তারা খামারে মুরগির কলেরা ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য আবেদন করেছে। একই অবস্থা দামুড়হুদা উপজেলার বেশ কয়েকটি খামারে। গতকালও শতাধিক মুরগি মরেছে সেখানকার একটি খামারে। দু একদিনের মধ্যে লেয়ার, ব্রিডার, ব্রয়লার মুরগির শেডের সব মুরগি বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওই এলাকার প্রতিষ্ঠিত খামারিরা ।
নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন পোল্ট্রি খামারির সাথে কথা বলে জানা গেছে, আগে কোনো খামারে বার্ড ফ্লু দেখা দিলে তা নিধন করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো এবং সরকারের তরফ থেকে মুরগি প্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হতো। বিগত ৭/৮ বছর ধরে এ ক্ষতিপূরণ দেয়া বন্ধ রয়েছে। মূলত এই ক্ষতিপূরণ দেয়া বন্ধ করার কারণেই খামারিরা গোপন করছেন বার্ড ফ্লুতে খামারের মুরগির আক্রান্ত হওয়ার কথা। আর প্রাণিসম্পদ অফিসে ’বার্ড ফ্লু’ অনেকটা নিষিদ্ধ শব্দের মতো । বিগত সময়ে চুয়াডাঙ্গায় বিচ্ছিন্নভাবে দু একটি খামারে বার্ড ফ্লুতে মুরগির মড়ক দেখা দিলেও সেগুলোকে বার্ড ফ্লু বলতে নারাজ তাঁরা । অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে বেসরকারি পশু চিকিৎসকরা যেখানে বার্ড ফ্লু বলে চিহ্নিত করেছেন, মেরে পুঁতেও ফেলা হয়েছে হাজার হাজার মুরগি আর সরকারি অফিসের পশু ডাক্তার সে রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে অন্য কোন রোগ দাবি করেছেন ।
খামারিরা বলছেন, নানা সমস্যা জর্জরিত এ খাতে ধারাবাহিক লোকসানে প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক পোল্ট্রি খামারি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এ বছর চুয়াডাঙ্গা জেলায় পোল্ট্রিতে যে ধরণের রোগের প্রার্দূভাব দেখা দিয়েছে তাতে অনেকেই পথে বসতে চলেছেন বলে ধারণা তাদের।
চুয়াডাঙ্গা বড়বাজার মুরগি বিক্রির শেডে গিয়ে দেখা গিয়েছে লেয়ার,ব্রিডার মুরগি বিক্রির প্রাধান্য। মুরগি বিক্রেতারা জানালেন, দিন পনের যাবত তারা বেশ কম দামে পাইকারি মুরগি কিনছেন। লেয়ার, সোনালি মুরগি ১শ ৫০ টাকা, ব্রিডার (প্যারেন্টস) ১শ ৬০ টাকা দরে কিনে আনছেন তারা। তবে, লেয়ার মুরগিতে অজ্ঞাত রোগের কথা জেনে অনেকেই তা খুচরো বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। মুরগির মড়ক দেখা দেয়ায় তারাও ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত।
বিশেষজ্ঞ এক পশু চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পোল্ট্রি খামার থেকে এইচ৫এন১, এইচ১এন১, এইচ৩এন১ এবং এইচ৯এন২-এই চার ধরনের ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর বিরূপ প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। তবে এইচ৫এন১ ভাইরাস মানুষের শরীরের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। বার্ড ফ্লুকে গোপন করা মোটেই সমীচীন নয়। অনেক খামারি বার্ড ফ্লু আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি গোপন রেখে আক্রান্ত মুরগি দ্রুত বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলোর দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। চুয়াডাঙ্গা জেলার পোল্ট্রি খামারে ছড়িয়ে পড়া রোগ যদি বার্ড ফ্লু না হয় তাহলে অন্য কী কারণ সেটিও দ্রুত বের করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য থেকে জানা যায়, পোল্ট্রি খামারিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকার এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্রজেক্ট (এআইপিআরপি) নামে একটি প্রজেক্ট চালু করে। বার্ড ফ্লু আক্রান্ত এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এ প্রজেক্টের অধীন ১১ শতাধিক কর্মী কাজ করতেন। আর এই প্রজেক্ট থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়া হতো। এ প্রকল্প থেকে ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত খামারিদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় ২৫ কোটি টাকা। কিন্তু দেশে বার্ড ফ্লু আর নেই উল্লেখ করে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর এ প্রকল্প বন্ধ করে দেয়া হয়। অথচ ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় বার্ড ফ্লুর সন্ধান পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময়। ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গা শহরের ইসলামপাড়ার মেসার্স মুন্সি পোল্ট্রি খামারে বার্ড ফ্লু ধরা পড়ে। বিষয়টি জানাজানির পর প্রশাসনের উদ্যোগে অভিযান চালানো হয়। এ সময় খামারটির প্রায় দুই হাজার মুরগি মেরে মাটিচাপা দেয়া হয়। সেবারও জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের পক্ষ থেকে বার্ড ফ্লু ঘোষনা দেয়া হয়নি।
চুয়াডাঙ্গা জেলার অনেক মুরগির খামারে বার্ড ফ্লু সাদৃশ্য অর্থাৎ মুরগি ঝিঁমানো, মাথা ফুলে যাওয়া, গায়ের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া, মাথার উপরের ফুল কালচে রঙ ধারণসহ যে ধরণের মড়ক দেখা দিয়েছে এর কারণ অনুসন্ধানে উচ্চতর পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিসের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন পোল্ট্রি খামারিরা । একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ক্ষতিপূরণের দাবি উঠেছে।