এত বড়মাপের শিল্পী হলেও এন্ড্রুদার মধ্যে অহম ভর করেনি

 

বিনোদন ডেস্ক: এন্ড্রুদা [এন্ড্রু কিশোর] একাধারে বন্ধু, বড় ভাই এবং প্রিয় শিল্পীদের একজন। তিনি এক অসাধারণ প্লেব্যাক শিল্পী- এই কথা আমার মতো অনেকেই স্বীকার করবেন; এতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৮২ সালে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন থেকেই বড় ভাইয়ের স্নেহ পেয়েছি তার কাছে। একসঙ্গে বহু ছবিতে গান করেছি আমরা। একসঙ্গে কাজ করা আর কাছাকাছি থাকার সুবাদে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি, তিনি কতটা গোছানো, বন্ধুবৎসল, সদালাপি মানুষ। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এত বড়মাপের শিল্পী হওয়ার পরও তার মধ্যে কখনও অহম ভর করেনি। কিছুটা নিভৃতচারী এবং যাবতীয় আত্মপ্রচার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন। এমন নিরহঙ্কার শিল্পী এই যুগে সত্যি খুঁজে পাওয়া কঠিন। একটা ঘটনার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। নাদিম-শাবানা জুটির ‘শক্তি’ ছবির বাংলা ভার্সনের কাজ চলছে। ছবির বাংলা গানগুলোর সঙ্গীত পরিচালনা করবেন আলাউদ্দিন আলী। তিনি আমাকে আর এন্ড্রুদাকে একটি উর্দু গানের বাংলা ভার্সন গাওয়াবেন। তাই আমাদের দু’জনকে বললেন, ‘তোরা এই গানটা তুইলা আন, এরপর রেকর্ড করুম। কিন্তু গান রেকর্ড করতে গিয়ে আলাউদ্দিন ভাই রেগে অস্থির। বলেছেন, নোটের এক জায়গায় ভুল হচ্ছে। তোরা কি গান তুলে আনোস নাই? কী বলব, আসলেই আমাদের গানটা ঠিকভাবে তোলা হয়নি। এমন সময় এন্ড্রুদা বললেন, ‘বিশ্ব, সরি, আমি গানটা ঠিকমতো তুলি নাই। এজন্যই গানের নোটে বারবার ভুল হচ্ছে।’ সিনিয়র শিল্পী হয়েও আমার কাছে এন্ড্রুদা ভুল স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেননি, এখানেই তার মাহাত্ম্য। আশির দশকে এন্ড্রুদা আর আমার মধ্যে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। দেখা গেছে, আলাউদ্দিন আলী যেসব ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, তার বেশিরভাগ গানের প্লেব্যাক শিল্পী আমি।  অন্যদিকে আলম খানের সঙ্গীত পরিচালনায় এন্ড্রুদা নিয়মিত গাইছেন। তখন এই দুই সঙ্গীত পরিচালকের কাজ নিয়ে যতটা আলোচনা, ততটাই আমাদের নিয়ে। আবার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝেও একসঙ্গে বহু গান গেয়েছি আমরা। আমাদের গানগুলো দুই বন্ধু, দুই ভাইয়ের চরিত্রগুলোর কণ্ঠে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ভালো কিছু করে দেখানোর জন্য যতই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠি না কেন, দিন শেষে আমাদের সম্পর্কটা থাকে ভাই-বন্ধুর। একসঙ্গে আড্ডা, গান-বাজনা নিয়ে আলোচনায় অনেকটা সময় পার করতাম আমরা। এই আড্ডার সূত্র ধরেই টিভি অনুষ্ঠানে আমাদের একসঙ্গে গান গাওয়া। যদিও আশি-নব্বই দশকে অসংখ্য ছবিতে আমরা গান করেছি। কিন্তু টিভি অনুষ্ঠানে আমাদের একসঙ্গে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক পরে। হানিফ সংকেতের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ‘ইত্যাদি’ একাধিক পর্বে একসঙ্গে গান করেছি আমি আর এন্ড্রুদা। ভালো লাগার আরেকটি বিষয় হলো, এন্ড্রুদা শুধু আমার সঙ্গে দ্বৈত ও সম্মিলিত গানই শুধু করেননি; আমার সুরেও গেয়েছেন। দেশাত্মবোধক গান ছাড়াও আমার সুরে প্লেব্যাক করেছেন ‘স্বামী-স্ত্রীর ওয়াদা’ ছবিতে। প্লেব্যাক বিষয়ে এন্ড্রু কিশোর সবসময় খুব সচেতন ছিলেন। প্রতিটি গানের পেছনে তার যে শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা চোখে পড়ত; তা খুব কম শিল্পীর বেলায় দেখা গেছে। তার অনেক কিছুর মতো এই বিষয়টাও আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। এ কারণেই দেশীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে এন্ড্রু কিশোরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে তার অবদান যে কতখানি, তা কথায় প্রকাশ করা যাবে না। একটা বিষয় অনেকের হয়তো জানা নেই। তাহলো তিনি প্রথম পুরুষ কণ্ঠশিল্পী, যিনি বলিউডে প্লেব্যাক করেছেন। রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘বিরোধ’ ছবির একটি গানের হিন্দি ও বাংলা দুই ভার্সনে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনি। অথচ এই অভিজ্ঞতার কথা কখনও তিনি কোথাও বলে বেড়ান না। হয়তো এ কারণেই তার শিল্পীজীবনের অনেক অভিজ্ঞতা ও অর্জন অনেকের আড়ালে থেকে গেছে। তারপরও এটাই সত্যি যে, তার মতো শিল্পী যুগে যুগে আসে না। একজন এন্ড্রু কিশোরের তুলনা করা যায় শুধু তার সঙ্গেই।