৭ মামলার প্রধান আসামি খাসকররা ইউপি চেয়ারম্যান ৪ মাস ধরে পলাতকঃ ইউনিয়নবাসির দুর্ভোগের সীমা নেই

 

রহমান মুকুল/আতিক বিশ্বাস: প্রায় ৪ মাস ধরে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন আলমডাঙ্গার খাসকররা ইউনিয়নবাসী। তিওরবিলা গ্রামে একটি পাড়ার সকল বসতবাড়ি পুড়িয়ে ভস্মীভূত করায় সাতটি মামলার প্রধান আসামি হয়ে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান গত ৪ মাস যাবত পলাতক। নেই প্যানেল চেয়ারম্যান। নেই ইউনিয়ন পরিষদের সেবা।

সরেজমিনে খাসকররা ইউনিয়ন ঘুরে দেখার এক পর্যায়ের গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে খাসকররা বাজারের আব্দুর রহিমের চায়ের দোকানে কথা হয় দোকানীর সাথে। এক পর্যায়ে আব্দুর রহিম বলেন, তিনি বিদেশ যেতে ইচ্ছুক। পাসপোর্ট-ভিসা তৈরির জন্য প্রয়োজন জন্মসনদ। চেয়ারম্যান পলাতক সে কারণে ইউনিয়ন পরিষদে প্রায় ১৫ দিন ঘুরে ঘুরে জন্মসনদ পেয়েছি। এ সময় দোকানে অনেকেই ছিলেন। তাদের মধ্যে খাসকররা গ্রামের ধুলো জোয়ার্দ্দারের ছেলে ওলিউর রহমান বলেন, তার ওয়ারিশ সার্টিফিকেট প্রয়োজন। প্রায় ২০ দিন ঘুরে ঘুরে অবশেষে পেয়েছেন বলে জানান। রায়সা গ্রামের প্রতিবন্ধী জহুরুল ইসলামের মেয়ের উপবৃত্তির জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে জন্মসনদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে শূণ্য হাতে ফিরেছেন। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতির কারণে প্রতিবন্ধীভাতা বন্ধ হয়ে আছে বলে জানান খাসকররা গ্রামের ইকলাস উদ্দীনের প্রতিবন্ধী ছেলে ইয়াছিন আলীর, মোবারেক মণ্ডলের প্রতিবন্ধী মেয়ে মালঞ্চ খাতুনের, রায়সা গ্রামের আজিজুল ইসলাম বধির ছেলে সাদ্দাম হোসেনের, নিশ্চিন্তপুরের দলিল উদ্দীনের প্রতিবন্ধী ছেলে খবির উদ্দীনের।

খাসকররা বাজারে অবস্থানের আগে বেলা প্রায় ২টার দিকে খাসকররা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে উপস্থিত হলে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউপি সচিব আব্দুস সামাদ। তার টেবিলে ভিড় করে আছেন ৩ ইউপি সদস্য ও নিতান্তই প্রয়োজনে আসা বিভিন্ন গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি। চেয়ারম্যানের যাবতীয় দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে সচিব আব্দুস সামাদকেই। বেশ ব্যস্ত তিনি, তবুও বেশ হাসিখুশি। সচিবের টেবিলেই কথা হয় রামদিয়া গ্রাম থেকে আসা শাহাদত মণ্ডলের ছেলে আলী হোসেনের সাথে। আলী হোসেনের ছেলে কায়েতপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র। উপবৃত্তির জন্য নতুন করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে জরুরীভাবে তার জন্মসনদ প্রয়োজন। কিন্তু সচিব তাকে জন্মসনদ দিতে অপারগতার কথা জানালেন। কেনো তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, হারিয়ে যাওয়া সনদপত্র নতুন করে নিতে হলে চেয়ারম্যানের দুটি স্বাক্ষর প্রয়োজন। জানা গেছে চেয়ারম্যান ঢাকাতে আছেন। চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর করিয়ে আনতে গড়ে এক সপ্তা করে সময় লাগে। তাহলে কীভাবে জরুরীভাবে জন্মসনদ দেবো? বিষয় ভালোভাবে আলী হোসেনকে বুঝিয়ে বললে তিনি হতাশ হন। কষ্টে-ক্ষোভে তিনি আর কোনো কথা না বলে হনহন করে বের হয়ে গেলেন। তার সাথে আসা ব্যক্তি বলেন তাহলে আর আলী হোসেনের ছেলের উপবৃত্তি হলো না।

তারা দুজন সচিবের কক্ষ থেকে বের হতে না হতেই উপস্থিত হলেন কাবিলনগরের দুজন। আদালত মণ্ডলের ছেলে তোফাজ্জেল ও আব্দুল কাদেরের ছেলে জোয়াদ আলী। তারা কোরবানির ঈদে পোষা গরু বিক্রি করেছেন। বর্তমানে নতুন করে গরু কিনবেন মোটাতাজা করার জন্য। সেজন্য ব্যাংকের লোন প্রয়োজন। লোন গ্রহনের ফাইলে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট প্রয়োজন। সে কারণে ব্যাংক থেকে ছুটতে ছুটতে ইউনিয়ন পরিষদে এসেছেন। অথচ চেয়ারম্যান নেই। কে দিবে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট? শেষ পর্যন্ত তারাও হতাশা আর দ্বিধা নিয়ে ফিরে গেলেন।

সচিব জানান, প্রতিদিন প্রায় ৩০/৪০ জন আসছেন বিভিন্ন সনদ নিতে। চেয়ারম্যান না থাকায় ফিরছেন হতাশ হয়ে। তিনি আরও বলেন, এই ইউনিয়নে ৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি আলিম মাদরাসাসহ ১টি কলেজ রয়েছে। সে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বর্তমানে উপবৃত্তি দেয়া হবে ডাচবাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু ব্যাংকের শিক্ষার্থীদের অ্যাকাউন্ট খুলতে জন্মসনদ প্রয়োজন। মাত্র ২/১ দিনের মধ্যেই এ জন্মসনদ প্রয়োজন। অথচ চেয়ারম্যান অনুপস্থিতির কারণে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে ২/১ দিনের মধ্যে কোনোভাবেই তা দেয়া সম্ভব না। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের অনেকে উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন বলেও তিনি স্বীকার করেন। তিনি আরও বলেন, চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকার কারণে ইউনিয়নের সকল সেবামূলক কার্যক্রম থেকে গেছে।

খাসকররা ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নং ওয়ার্ডের চার চার বারের নির্বাচিত সদস্য ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদে প্যানেল চেয়ারম্যান মনোনীত করা হলেও আমাদের চেয়ারম্যান ইচ্ছাকৃতভাবেই তা করেননি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইচ্ছা করলে ইউনিয়নবাসীর এ দুর্ভোগ লাঘব করতে পারেন। তিনি প্যানেল চেয়ারম্যান মনোনীত করে তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার অর্পণ করতে পারেন।

এ ব্যাপারে আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আজাদ জাহান বলেন, আইনানুগভাবে জনগণের স্বার্থে যা কিছু করা সম্ভব তা করতে দ্বিধা নেই। প্যানেল চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনের বিধিমালা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য, গত ৬ জুন তিওরবিলার নজরুলকে নৃশংসভাবে হত্যার পর একই গ্রামের ৮/১০ জনের বসতবাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে পরিকল্পিতভাবে ভস্মীভূত করা হয়। অভিযোগ ওঠে ওই মধ্যযুগীয় বর্বরতার নেতৃত্ব দেন স্বয়ং ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ও তার ভাই-ভাতিজিরা। এ ব্যাপারে আলমডাঙ্গা থানায় ৬টি ও আদালতে ১টি মামলা দায়ের করা হয়। প্রত্যকটি মামলায় তিনি প্রধান আসামি। এ ঘটনার পর থেকে প্রায় ৪ মাস ধরে তিনি পলাতক আছেন।