৩শ আসনে সাড়ে ৩ হাজার প্রার্থী নৌকার টিকিট চান , প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে তিন স্তরের জরিপ চলছে

 

স্টাফ রিনপোর্টার: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ আসনে সাড়ে তিন হাজারেরও অধিক প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে আগ্রহী। এরমধ্যে চার শতাধিক শিক্ষিত তরুণ রয়েছেন। তাদের অর্ধেকই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। জানা গেছে, এবার জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেবে আওয়ামী লীগ। আর জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাই করতে তিন স্তরের সাংগঠনিক জরিপ চলছে। এ ছাড়া দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে একাধিক গোয়েন্দা জরিপও চলছে। সম্প্রতি সাংগঠনিক এক জরিপ রিপোর্টে উঠে এসেছে, ‘৩শ’ আসনের প্রতিটিতে গড়ে ১২ জন করে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তারা ইতোমধ্যে আট-ঘাট বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছেন। এ কারণে মনোনয়ন প্রত্যাশী ও বর্তমান এমপিদের মধ্যে অনেকটা ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়েছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। এতে সম্ভাব্য অনেক এমপি প্রার্থী এখন এলাকা ছাড়া।’

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে না। এ কারণে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আগামী নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দলের জন্য পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছেন। জনগণের মন জয় করতে মাঠে নামার জন্য এক বছর আগেই এমপিদের মাঠে নামার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। সম্প্রতি দলের হাইকমান্ড থেকে বর্তমান এমপি ও সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বলা হয়েছে, ‘এলাকায় যাও, জনগণের মন জয় করে মনোনয়ন নাও। যারা এলাকাবিমুখ, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না।’

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও জোর মনিটরিং চালাচ্ছেন। ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় সংলগ্ন বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ভবনে গত তিন এপ্রিল থেকে নির্বাচনী পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করেছেন। সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যকে ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে ডেকে তাদের সংশোধন হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সংশোধন না হলে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।

দলীয় সূত্র জানায়, অনেক এমপির কার্যক্রম নিয়ে দলের ভিতরে বাইরে প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমানের অনেক এমপি নেতাকর্মী বিচ্ছিন্ন। দলকে পরিণত করেছেন ‘ব্যক্তিলীগে’। দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা ভিড়তে পারেন না তাদের কাছে। এসব এমপির কাছে হাইব্রিডদের কদর সর্বাগ্রে। কেউ কেউ আবার দলীয় নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে ছেলেমেয়ে ও বউয়ের আত্মীয়-স্বজন দিয়ে দল পরিচালনা করছেন এলাকায়।

আওয়ামী লীগের সাংগঠটিক জরিপে উঠে এসেছে, এবার এমপি হতে চান। এরমধ্যে উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও রয়েছেন। আবার কেউ কেউ  রাজনীতিতে পা দিয়েই এমপি হওয়ার টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছেন। সাবেক বা বর্তমান মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। দেশজুড়ে রাস্তায় রাস্তায়, নগর-শহর থেকে গ্রামীণ জনপদেও টানানো হচ্ছে তাদের নামে ডিজিটাল ব্যানার ও রঙিন পোস্টার। প্রচারণা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন মাধ্যমেও। অযোগ্যদের ভিড়ে যোগ্য নেতারাও এখন কোণঠাসা। এদিকে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এটা ধরে নিয়েই দলকে প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

দলের একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এর আগে ছয় মাস পরপর সংসদ সদস্যদের অবস্থা এবং দুর্বল আসনগুলোতে বিকল্প কী হতে পারে, তা দেখার জন্য জরিপ করিয়েছেন। এখন তিন মাস পরপর এ জরিপ করানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে মাঠপর্যায়ে দলের কোন্দল এবং সংসদ সদস্যদের সঙ্গে জনমানুষের দূরত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে।

আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, দলের প্রতি অনুগত, ‘গুড ইমেজ’ ও দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রিয় প্রার্থী খুঁজছে আওয়ামী লীগ। দলের সাংগঠনিক রিপোর্ট, সরকারি-বেসরকারি জরিপেও গুরুত্ব পাচ্ছে এগুলো। ইতিমধ্যে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদকরা জেলায় জেলায় সফর করে নানা বিষয় ‘তুলে আনছেন। নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বর্তমান এমপিদের অবস্থান উঠে আসছে সাংগঠনিক প্রতিবেদনে। পাশাপাশি এমপিদের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাকেও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বর্তমান এমপি ছাড়াও সম্ভাব্য যোগ্য প্রার্থীদের প্রসঙ্গেও তৈরি হচ্ছে এসব প্রতিবেদন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, আগামী নির্বাচন আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে চাই। দল অবশ্যই সত্, যোগ্য, কর্মীবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রিয় লোককে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেবে। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘জনসম্পৃক্ততা আছে, দল ও জনগণের প্রতি কেমন কমিটমেন্ট আছে, দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে অবস্থান ভালো— এমন নেতাদের আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগে মনোনয়ন দেয়া হবে।’

দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের ৬০ থেকে ৭০ জন এমপি বিভিন্ন কারণে দল এবং দলের বাইরে বিতর্কিত। এসব এমপির ব্যাপারে চরম নেতিবাচক বার্তা প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে। তারা এলাকা ও দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না। মাঝে মাঝে ঘুরে আসেন নিজের বাড়ি থেকে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ কাউকেই সময় দেন না। জনপ্রিয়তাও শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে তাদের। এসব আসনের জন্য বিকল্প প্রার্থী সন্ধান করা হচ্ছে। দলটির কয়েকজন এমপির বিরুদ্ধে দলীয় নেতা-কর্মী হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। জমি দখল, মাদক ব্যবসা, বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ যেসব এমপিদের বিরুদ্ধে রয়েছে, তাদের আসনে বিকল্প প্রার্থী দেয়ার কথা ভাবছেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।

আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জানান, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডও সম্প্রতি দলীয় এমপিদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, এবার মনোনয়ন দেয়া হবে তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিরা বেশ নড়েচড়ে বসেছেন। নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরাও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমানে একজন সংসদ সদস্য সম্প্রতি তার নির্বাচনী এলাকায় নেতাকর্মীদের নিয়ে এক চায়ের দোকানে বসেন। ১০ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি বলে স্থানীয় নেতারা জানান।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বড় দুশ্চিন্তা অভ্যন্তরীণ কোন্দল। আর একটি সমস্যা হচ্ছে জনমানুষের সঙ্গে দলের সংসদ সদস্যদের দূরত্ব।