২৫ অক্টোবর : রাজনৈতিক উত্তাপ-আতঙ্কে ব্যবসা-বাণিজ্যেও স্থবিরতা

৯০ দিনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বর্তমান সরকার একটি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ নেবে?

স্টাফ রিপোর্টার: কী ঘটতে যাচ্ছে ২৫ অক্টোবর? জবাব মিলছে না। স্বচ্ছ জবাব কোনো পক্ষ থেকে তো মিলছেই না, উপরন্ত পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে শঙ্কিত দেশের মানুষ।

বর্তমান সরকার আগামী ২৫ অক্টোবর থেকে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে; এমন ধারণা থেকেই এ তারিখ ঘিরে এতো আলোচনা। এদিন সরকারি দল আওয়ামী লীগ ঢাকায় সমাবেশ ডেকেছে। একইদিন প্রধান বিরোধীদল বিএনপিও রাজধানীতে সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অন্যদিকে বিরোধীদল সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি জানাচ্ছে। আর সরকারি দল ২৪ অক্টোবরের পরেও, অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত সংসদের চলতি ও শেষ (সম্ভবত) অধিবেশন চালাতে চাচ্ছে। প্রধান দু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাল্টাপাল্টি এ অবস্থানের কারণে ২৫ অক্টোবরকে ঘিরে শুরু হয়েছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা, জনমনে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ও শঙ্কা। অপরদিকে সমঝোতারও প্রক্রিয়া গোপনে চলছে বলে কিছু সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে। যদিও তাতে স্বস্তি নেই।

রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সংস্থার সূত্রগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, যদি সত্যিই ২৫ অক্টোবর সরকার ও বিরোধীদল রাজধানীতে শক্তি প্রদর্শনের কিংবা বড় ধরনের মহড়ার পরিকল্পনা করে থাকে, তাহলে জানমালের নিরাপত্তায় প্রশাসন ওইদিন ১৪৪ ধারা জারি করতে পারে। উভয় দলকে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করা থেকে বিরত রাখতে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রশাসনে আগাম এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। অবশ্য অতীত উদাহরণ টেনে রাজনৈতিক সূত্রগুলো এমন আভাসও দিচ্ছে যে, শেষ পর্যন্ত যেকোনো একটি পক্ষ ওইদিন সমাবেশ স্থগিত কিংবা বাতিল করতে পারে। আবার সব ধারণা বা অনুমান এলোমেলো করে দিয়ে পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় নিতে পারে বলেও মনে করছে কোনো কোনো সূত্র।

বিরোধীদলসহ কেউ কেউ ধারণা করছে, ২৪ অক্টোবরের পরেই ৯০ দিনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বর্তমান সরকার একটি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ নেবে। ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর এ বক্তব্যের কারণেই এ ধারণার অবতারণা। সরকারের একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার সাম্প্রতিক বক্তব্যে এ ধারণা আরও শক্ত হয়েছে। যে কারণে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও বলেছেন, আমরা ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত দেখবো, এরমধ্যে সরকার নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে না নিলে ২৫ অক্টোবর থেকে আন্দোলন। সরকার ও বিরোধীদলের এমন বক্তব্যের কারণেও ২৫ অক্টোবর এখন অন্যরকম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল শুক্রবার নিজ নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ২৪ অক্টোবরকে ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার কিছু নেই। এটা কোনো বিশেষ দিনও নয়। কোনো কোনো মহল দিনটিকে ঘিরে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান সরকারের মেয়াদ রয়েছে। এর আগে ৯০ দিনের মধ্যে যেকোনো দিন নির্বাচন হতে পারে। সেটি ৮০তম কিংবা ৮৫তম দিনেও হতে পারে। ২৪ অক্টোবরের পরেও সংসদের চলতি অধিবেশন চালানোর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কার্য উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অধিবেশন কতোদিন চলবে তা নির্ধারণ করবেন স্পিকার। তার মতে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সংসদ চলতে কোনো বাধা নেই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতাদের এ বক্তব্যের সাথে একমত নয় বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, কার্য উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত হচ্ছে-সংসদের চলতি অধিবেশন ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে। কিন্তু এখন সরকারি দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা এরপরও অধিবেশন চালানোর কথা বলছেন। নির্বাচন না করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতেই তারা এ ধরনের কথা বলছেন। এর মধ্যদিয়ে সরকার দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার ফলে জনমনেও এ শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, নির্বাচন আদৌ হবে কি-না।

এদিকে বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিতসভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২৫ অক্টোবর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করা হবে। বিএনপিও একইদিন রাজধানীতে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে আবেদন করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পল্টন ময়দান অথবা নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের অনুমতি চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

পাল্টাপাল্টি এ কর্মসূচির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ২৫ অক্টোবর সমাবেশের নামে আন্দোলন করে ৫ মে’র মতো আরেকটি হেফাজতি কাণ্ড ঘটাতে দেয়া হবে না। ২৪ অক্টোবরের পর দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করা হলে একটি নির্বাচিত সরকার তা চেয়ে চেয়ে দেখবে, এমন ভাবার কোনো অবকাশ নেই। ২৫ অক্টোবর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়-বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদেরও গতকাল বলেন, বিরোধীদলের আন্দোলনের হুমকি অসাড়ের তর্জন-গর্জন। দেশ চলবে সংবিধান অনুযায়ী।

২৫ অক্টোবরকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক: সরকার ও বিরোধীদলের ২৫ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (সদর) আনোয়ার হোসেন গতকাল বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সমাবেশের ব্যাপারে কোনো পক্ষ থেকে কেউ আবেদন করেনি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ২৫ অক্টোবর সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষ করে জঙ্গি সংগঠনগুলো বেশ তত্পর রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে বোমা তৈরি করার সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ধরাও পড়েছে বেশ কয়েকজন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন তথ্য মিলেছে। সরকারকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। সম্ভাব্য নাশকতার স্থানগুলোতে গোয়েন্দা তত্পরতা বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমাবেশের আগেই ১৪৪ ধারা জারি করা হতে পারে। ৱ্যাবের মহাপরিচালক মোখলেসুর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৱ্যাবের পক্ষ থেকে সবধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সমাবেশের অনুমতি দেয়া বা না দেয়া সরকারের বিষয়। কিন্তু পুলিশের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কাজ করবে।

পুলিশ সদর দফতরসূত্রে জানা গেছে, সরকারি দলের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ব্যাপারে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে ব্যঙ্গাত্মক গান, দলীয় সঙ্গীত ও কবিতা লেখা হয়েছে। এগুলোর সিডি তৈরি করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিরোধীদলের নেতাদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। ২৫ অক্টোবরের সমাবেশে বিরোধীদলের পক্ষ থেকে এসব ব্যঙ্গাত্মক গান, দলীয় সঙ্গীত ও কবিতা পরিবেশন করা হবে। এ নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধীদলের মধ্যে সংঘর্ষ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন অতিরিক্ত কমিশনার জানান, সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর আবাসিক হোটেল ও মেসগুলোতে নজরদারি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ডিএমপি থেকে কয়েকদিন আগে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশ আবাসিক হোটেল ও মেসগুলোতে তল্লাশি করছে। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের কর্মীদের দিকে পুলিশ বেশি নজর দিচ্ছে।

অনুকূলে রাখার তীব্র প্রতিযোগিতা; পাশাপাশি পরস্পরকে চাপে রাখার কূটকৌশল। এর সূত্র ধরেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করেছে। দেশের সার্বিক এ পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল অস্বস্তিকর বলে মনে করছেন। তাদের মতে, সমঝোতার সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খানের মতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় এখন হিসাব মিলিয়ে দেখছে কোনটিতে তাদের লাভ। এজন্যই কেউ তারা মাঠ ছাড়তে চাইছে না; ছাড়ও দিতে চাইছে না। ফলে দেশে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। একেবারে শেষ সময়ে এসেও সমঝোতা না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রবীণ রাজনীতিক দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, আমরা কবে একমত হয়েছিলাম? ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গতবারও ব্যর্থ হয়েছি, এবারও সে পথেই আছি। তবে ’৯৬-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারই একমাত্র শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলো।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এখন পরিস্থিতি অস্বস্তিকর হলেও এক সময় স্বস্তিকর হবে। সমঝোতার ব্যাপারে এখনও আশাবাদী বলেও জানান তিনি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি এখন পর্যন্ত একবারও বলেনি তারা সমঝোতার বিপক্ষে। কিন্তু সরকারই নানা হিসাব কষে ভয় পাচ্ছে। ফলে তারা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চাইছে। কিন্তু এ সুযোগ তো আর হবে না। কারণ বিএনপির পক্ষে জনগণ আছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। কারণ বিএনপির প্রত্যাশা থাকলেও সরকারি তরফে এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। বরং ক্ষমতা সংহত করার জন্য সরকার নানাভাবে তৎপর। ফলে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।