২০ দলে টানাপোড়েন : জোটভুক্ত জামায়াতকে নিয়ে সন্দেহ অবিশ্বাস

 

স্টাফ রিপোর্টার: জোট সম্প্রসারণসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে টানাপোড়েন চলছে। সরকারবিরোধী কর্মসূচি না দেয়া, শরিকদের সাথে আলোচনার আগেই কর্মসূচি চূড়ান্ত করা, শরিকদের যথাযথ মূল্যায়নের অভাবসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু ইস্যুতে এ বিরোধ দেখা দেয়। আবার জোটের একাধিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের ঘটনায় বিএনপি ও শরিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতকে নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস।

সূত্র বলেছে, আজ সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করবে তারা। আজকের হরতালকে এসিড টেস্ট হিসেবে দেখছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর বিএনপির নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটির জন্য এটি প্রথম অগ্নিপরীক্ষা। সরকারের সাথে জামায়াতের আঁতাতের যে গুঞ্জন উঠেছে, আজকের হরতালে সে বিষয়ও কিছুটা স্পষ্ট হবে। হরতালে জামায়াত-শিবিরের উপস্থিতির দিকে বিএনপিসহ অনেকেরই নজর থাকবে।

জোটের দুর্বলতাগুলো কাজে লাগাচ্ছে সরকার। জোট ভাঙতে নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে কয়েকটি দলকে বের করে আনার চেষ্টা চলছে। লোভে পড়ে ইতোমধ্যে জোট ছেড়েছেন শেখ শওকত হোসেন নীলু নেতৃত্বাধীন এনপিপির একাংশ। সর্বশেষ শনিবার আলমগীর মজুমদারের নেতৃত্বাধীন এনডিপির একাংশ জোট ছাড়ার আলটিমেটাম দিয়েছে। তবে প্রকাশ্যে এসব টানাপোড়েনকে পাত্তা না দিলেও বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছে বিএনপি। শরিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি আলাদা বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের অভিযোগ ও তা সমাধানেরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বিএনপির নীতিনির্ধারক ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।

জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০ দলীয় জোটে কোনো টানাপোড়েন নেই। সরকার জোট ভাঙার চেষ্টা চালাচ্ছে। ৫ জানুয়ারির আগেও জোট ও বিএনপির অনেককে ভাগিয়ে নিতে নানা প্রলোভন দেখানো হয়। কিন্তু সরকারের সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তবে সম্প্রতি সরকারের লোভে পড়ে এনপিপির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নীলু জোট ছেড়ে চলে যান। তিনি বলেন, জোটের শরিকদের সঙ্গে নিয়মিত তাদের যোগাযোগ রয়েছে। আগের চেয়ে জোট আরও বেশি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ আছে।

সাইনবোর্ড বা নামসর্বস্ব দল নিয়ে জোট সম্প্রসারণ করায় শুরু থেকেই বিএনপির ভেতরে রয়েছে অসন্তোষ। দলের একটি বড় অংশের বিরোধিতার পরও শুধু সংখ্যার দিক থেকে জোট বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় বিএনপি হাইকমান্ড। এক্ষেত্রে কোনো কিছুই বিবেচনা করা হয়নি। এক ব্যক্তির এক দল- এমন অনেককেই নেয়া হয় জোটে। বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনে তাদের ভূমিকা কি ছিল তা সবাই অবগত। সভা-সমাবেশে বক্তৃতা আর বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো তাদের কার্যক্রম। এসব দলের সাংগঠনিক কাঠামো বলতে কিছুই নেই। অনেক দলের নেই কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটিও। এমনকি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সামনে যারা কথা বলতে ভয় পেত, এখন তাদের অনেকেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। বসেন তার পাশের চেয়ারেই। এ নিয়ে বিএনপির অনেকেই ক্ষুব্ধ। তারপর ওইসব প্যাডনির্ভর দলে ভাঙন আর দলাদলিতে জড়িয়ে পড়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাপা অসন্তোষ। সম্প্রতি গণমাধ্যমে এসব খবরেও বিব্রতবোধ করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এসব প্যাডসর্বস্ব দলকে জোটে নেয়ার আদৌ প্রয়োজন ছিল কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠছে।

এ বাস্তবতায় আবারও নামসর্বস্ব কিছু দলকে জোটে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই তালিকায় আছে, এহসানুল হুদার জাতীয় দল, মঞ্জুর হোসেন ইসার নিউ জেনারেশন পার্টি, মমতাজউদ্দিন চৌধুরীর ভাসানী ফ্রন্টসহ আরও কয়েকটি প্যাডনির্ভর বামপন্থি দল। জোটের শরিক প্যাডনির্ভর একটি দল এদের জোটে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্যাডসর্বস্ব এসব দলকে জোটে নেয়ার গুঞ্জনে বিএনপি ও কয়েকটি শরিক দলের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। জোটের অন্যতম শরিক এলডিপির নেতারা প্রকাশ্যেই এর বিরোধিতা করছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতিতে এলডিপির মহাসচিব রেদওয়ান আহম্মেদ বলেন, শুধু সংখ্যার দিক দিয়ে জোটের পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। যাদের দেশব্যাপি সংগঠন আছে তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে এলডিপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, এলডিপি জোটের অন্যতম দল হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করছে না। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জোটের অভিজ্ঞ নেতাদের কোনো মতামত নেয়া হয় না। তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও দেশ রক্ষায় জোটের পরিধি বাড়ানো হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী এবং নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে এমন দলকেই জোটে আনা উচিত। কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই, সভাপতি আছে সাধারণ সম্পাদক নেই আবার সাধারণ সম্পাদক আছে সভাপতি নেই এমন হোন্ডা পার্টি, টেম্পো পার্টি জোটভুক্ত হলে আমাদের আপত্তি আছে। কারও মতামত না নিয়ে এভাবে জোট সম্প্রসারণ করা হলে ২০ দলীয় জোটে থাকব কিনা তা নতুন করে ভাবতে হবে।

তিনি বলেন, প্যাডসর্বস্ব দল নিয়ে জোটের পরিধি বাড়ানোর কারণেই বর্তমানে এই অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সামান্য লোভে পড়ে অনেকেই জোট ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন। তাই শরিকদের মধ্যে টানাপোড়েন নিরসনে অবিলম্বে জোট নেত্রী খালেদা জিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ মূল্যায়ন না করায় শরিকদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা। সাম্যবাদী দলের একাংশকে জোটে নেয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলোর তীব্র আপত্তি থাকলেও তা পাত্তা দেয়া হয়নি। কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও শরিকদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। আগে কর্মসূচি চূড়ান্ত করে পরে জোটের সাথে নিয়মরক্ষার বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। আন্দোলন কর্মসূচি চূড়ান্ত, জোটকে গতিশীল করাসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি কোর কমিটি গঠনে শরিকদের পক্ষ থেকে দাবি উঠলেও আজও তা হয়নি।

এদিকে নানা ইস্যুতে শরিকদের মধ্যে টানাপোড়নের পাশাপাশি জোটের ছোট ছোট দলগুলোর মধ্যে চলছে অন্তঃকলহ। এসব অন্তঃকলহের পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত স্বার্থ। যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এসব প্যাডনির্ভর দলের প্রধানদের সাথেই বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। ওইসব দলের সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিবদের তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। নিয়ম অনুযায়ী তা হওয়ার কথাও নয়। এই বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি কেউ কেউ। ফলে ব্যক্তিগত স্বার্থে তারা কলহে জড়িয়ে পড়ছেন। একে অপরকে বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটছে। এই কলহের সুযোগ নিচ্ছে সরকার। সবশেষ ২০ দলীয় জোটের শরিক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দলটির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন অংশ ২০ দলীয় জোটে থাকার ঘোষণা দেন। তবে আলমগীর মজুমদারের নেতৃত্বাধীন অংশ তাদের জোটে রাখতে হলে ৫ দফা দাবি পূরণের শর্ত দিয়ে শনিবার ৭২ ঘণ্টার সময় দিয়েছে বিএনপিকে। এর আগে ২০ দলের শরিক ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) এখন ভেঙে দুই টুকরা। একাংশের নেতৃত্বে শেখ শওকত হোসেন নীলু, আরেকাংশের নেতৃত্বে ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। ফরহাদের অংশ রয়েছে ২০ দলীয় জোটে। বাংলাদেশ মুসলিম লীগও দুই ভাগে বিভক্ত। দলের নির্বাহী সভাপতি কামরুজ্জামান খানকে বহিষ্কার করে একটি অংশ। পরে বিএনপির কারাবন্দি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বড় বোন জোবায়দা কাদের চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করে নতুন কমিটি করা হয়। তবে কামরুজ্জামান খানের অংশটি ২০ দলের সঙ্গে রয়েছে। শেখ আনোয়ারুল হকের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী-ন্যাপ) বিএনপি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে ভাসানী-ন্যাপ এখন ২০ দলীয় জোটের শরিক।
জানতে চাইলে জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, ২০ দলে তেমন টানাপোড়েন নেই। কোনো দল তো জোট ছেড়ে যায়নি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ হয়তো চলে যাচ্ছেন। তারা চলে গেলে জোটে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ রাজনীতি বা জোটে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সবাই অবগত। বরং জোটে থেকে তারা কিছুটা ইমেজ তৈরি করেন।

সরকারের পক্ষ থেকে তার সাথে যোগাযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার তো নানাভাবে জোটে ভাঙন ধরাতে চেষ্টা করছে। কারও সাথে আলাপ হওয়াটাকে তিনি দোষের কিছু দেখেন না। কেউ সরকারের প্রলোভনে পড়ে জোট ছেড়ে চলে গেলেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়।