১৮ দলের ৬০ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিন : সহিংসতায় নিহত ৫

যশোর অভয়নগরে যুবলীগ নেতা নগরকান্দায় বিএনপি নেতা জিয়ানগরে যুবলীগ কর্মী ঈশ্বরদীতে জামায়াত কর্মী ও বগুড়ার গাবতলিতে বিএনপি কর্মী নিহত

 

স্টাফ রিপোর্টার: সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ ও ধরপাকড়ের মধ্য দিয়ে ১৮ দলের ডাকা ৬০ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে। হরতাল সমর্থকদের সাথে দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের ত্রিমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। নিহত হয়েছে সরকার ও বিরোধীদলীয় ৫ নেতাকর্মী।

নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গতকাল সকাল থেকে ৬০ ঘণ্টার হরতাল শুরু হয়েছে। পুলিশের গুলিতে ফরিদপুরের নগরকান্দায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মারুফ হাসান ও পাবনার দাশুরিয়ায় শিবিরকর্মী জুলহাসউদ্দিন মুন্নাফ, ছাত্রলীগের হামলায় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে যুবদলকর্মী মোহাম্মদ সিদ্দিক, যশোরের অভয়নগরে পৌর যুবলীগ সম্পাদক আলমগীর হোসেন শিমুল এবং পিরোজপুরের জিয়ানগরে যুবলীগ কর্মী স্বপন শীল নিহত হন। সংঘর্ষে দেড়হাজারের মতো নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে বিরোধী দল বিএনপি। হরতালের প্রথম দিন রাজধানীর নানা জায়গায় ঘটেছে দফায় দফায় সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সিএমএম কোর্টের নথি শাখা, গাবতলী বিআরটিসি বাস ডিপো, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে পুলিশ ফাঁড়ি ও যাত্রাবাড়ীতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। কাকরাইলে প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের বাসভবনের সামনে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক অফিসসহ রাজধানীর অর্ধ শতাধিক পয়েন্টে দু শতাধিক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ২৫টি ককটেল ও বিপুল পরিমাণ গান পাউডার উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল ভোর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে হরতালের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল বের করে হরতাল সমর্থনকারীরা। হরতালের বিপক্ষে পাল্টা মিছিল বের করে সরকার দলীয় সংগঠন ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এছাড়া জয়পুরহাটে দুটি ট্রেন ভাঙচুরের পর হরতাল সমর্থকরা বগিতে আগুন দিয়েছে। চাঁদপুর, পাবনা, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, বগুড়া, কক্সবাজার, ফেনী, গাইবান্ধা, ঝিনাইদহ, কিশোরগঞ্জ, নাটোরসহ বিভিন্ন স্থানে হরতালকারীদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া হরতালে সারাদেশে একাধিক মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা ও যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরবসহ ১৫ হাজার বিরোধী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, ৬০০ জনকে গ্রেফতার এবং ১২ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে বলেও দাবি করেছে বিএনপি।

এদিকে প্রথমদিনের হরতালে রাজধানীর বেশির ভাগ যানবাহন চলাচল করেনি। বন্ধ ছিল বেশির ভাগ বিপনি বিতান ও শপিং মল। রাজধানী থেকে কোনো দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি। ব্যাহত হয়েছে রেল ও লঞ্চ চলাচল।
পাবনা ঈশ্বরদীর মুলাডুলিসহ বিভিন্ন স্থানে হরতাল সমর্থনে পিকেটিং এর সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সশস্ত্র হামলায় এক জামায়াত কর্মী নিহতসহ ১৮ দলের ৩০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ কর্মীদের ৮/১০টি বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। নিহত জামায়াত নেতার নাম জুলহাস উদ্দিন মুন্নাফ (৩৫)। তিনি ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ফরিদপুরের নগরকান্দায় স্বেচ্ছাসেবক দল কর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩০ জন নেতাকর্মী। সকালে ফরিদপুর শহর ও কোমরপুরে হরতালের সমর্থনে বিএনপি একটি বিক্ষোভ মিছিল করে কানাইপুরে চারটি গাড়ি ভাঙচুর করে। সকালে জেলার নগরকান্দা উপজেলায় হরতালের সমর্থনে ১৮ দলের বিক্ষোভ মিছিল চালালে উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য ফারুক নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশসহ আহত হয় ৩০ জন নেতাকর্মী।

পুলিশ ব্যারিকেড তোলার চেষ্টা করলে এ সময় বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ৫ রাউন্ড টিয়ারসেল ও ১৫ রাউন্ড রাবার বুলেট ও শটগানের গুলি ছোড়ে। পুলিশে গুলিতে বিএনপিকর্মী মারুফ শেখ গুরুতর আহত হন। আহত মারুফকে নগরকান্দা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। নিহতের বাড়ি মীরের কান্দি। পিরোজপুরে হরতালের প্রথম দিনে আওয়ামী লীগ-জামায়াত-বিএনপির সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও সাংবাদিক-পুলিশসহ আহত হয়েছে অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মী। পুলিশ সংঘর্ষ থামাতে ১৬ রাউন্ড শটগানের গুলি ও ১১ রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে। নাশকতার আশঙ্কায় পুলিশ জেলায় ৪ জামায়াত ও ৫ বিএনপি কর্মীকে আটক করেছে। ভোরে জিয়ানগর উপজেলার বালিপাড়া বাজারে জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বাড়ি ও দোকানপাটে হামলা চালায়। এ সময় তারা যুবলীগ কর্মী স্বপন শীলের বাড়িতে হামলা করে এবং তাকে কুপিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। তার স্ত্রী বাধা দিতে গেলে তার শ্লীলতাহানি ঘটায় এবং তাকে টেনেহেঁচড়ে রাস্তায় বের করে দেয়। এ সময় তাদের দু শিশুপুত্র আহত হয়। পরে হামলাকারীরা বালিপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সহসভাপতি বাপ্পি মোল্লা ও তার পিতা আলাউদ্দিন মোল্লাকে কুপিয়ে জখম করে। তাদের ৩ জনকেই গুরুতর আহত অবস্থায় পিরোজপুর সদর হাসপাতালে নেয়া হলে অবস্থার অবনতি দেখে খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নেয়ার পথে স্বপনশীল (২৭) মারা যান। যশোর শহরে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারসেল ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করেছে।

যশোরের চুড়ামনকাটি, সাতমাইল, কুয়াদাবাজার, রাজারহাট, রূপদিয়া, বসুন্দিয়া এলাকায় হরতাল সমর্থনকারী ও বিরোধীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব এলাকায় হরতাল সমর্থনকারীরা বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে। কুয়াদা বাজারে হরতাল সমর্থনকারীরা কোতোয়ালি পুলিশের ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাসে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে ৫ জন আহত হয়। তবে গতকালের হরতালে সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটেছে যশোরের শিল্পশহর নওয়াপাড়ায়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অভয়নগরে ও নওয়াপাড়াস্থ হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যে হরতাল সমর্থকরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন শিমুলকে হত্যা করে। এ ঘটনায় আহত হয় আরমান, জনি, লিমন, এনামুল ও বায়েজিদ নামে ৫ জন আহত হয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ হরতাল সমর্থকরা শিমুলের ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাসেও অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নওয়াপাড়া বাজারে পর্যাপ্ত পুলিশ, ৱ্যাব ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে লিমন ও এনামুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদেরকে খুলনা আড়াইশ’ বেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নওয়াপাড়া থানার ওসি আবদুস সালেক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, গতকাল সকাল ৮টার দিকে হরতাল ভেঙে যযুবলীগ নেতা শিমুলের নেতৃত্বে একদল হরতালবিরোধী একটি মাইক্রোবাসে করে নওয়াপাড়া বাজারে মহড়া দিচ্ছিলো। খবর পেয়ে একদল হরতাল সমর্থক মাইক্রোবাসটিকে ধাওয়া করে। অবস্থা বেগতিক দেখে যুবলীগ নেতা শিমুল মাইক্রোবাস থেকে নেমে পাশের একটি গুদাম ঘরে আশ্রয় নেন। এ সময় হরতাল সমর্থকরা ওই মাইক্রোবাসে অগ্নিসংযোগ করে এবং মাইক্রোবাসের যাত্রীদের বেধড়ক মারপিট করে। এক পর্যায়ে হরতাল সমর্থকরা পাশের হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির একটি কক্ষে ঢুকে শিমুলকে গণপিটুনি দেয়। হরতাল সমর্থনকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে শিমুলের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে। ঘটনাস্থলেই শিমুলের মৃত্যু হয়। বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় বিএনপির দু গ্রুপের সংঘর্ষে শাহজাহান (৩৫) নামের এক বিএনপি কর্মী প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে মারা গেছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও ৩জন।