হ্যাঁ, টার্গেট ইজ ভেরি হাই: অর্থমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার: বাজেটে এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের লক্ষ্য অর্জন সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, রাজস্ব বোর্ড এখন যথেষ্ট প্রস্তুত। তাই এবার ঠিক করেছি ধাক্কা দেয়ার সময় এসেছে। তাদের জনবল দ্বিগুণের মতো বাড়ানো হয়েছে। অগ্রগতির পথে যেতে চাইলে অতিরিক্ত উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের স্বার্থেই এ উদ্যোগের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়। গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে সরকারি চাকরিজীবীদের পে-স্কেল, প্রতিরক্ষা বাজেট ও জনপ্রশাসন খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ সম্পর্কে কোন জবাব দেননি।

শেষপর্যায়ে অর্থমন্ত্রী মুহিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব দেয়া যাবে না। আর জবাব দেয়াটা সমীচীনও নয়। অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিবছরই করদাতা বাড়ছে। তবে গতি মন্থর। হ্যাঁ, টার্গেট ইজ ভেরি হাই। অতীতের রেকর্ড বলছে আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে পারবো। এ সংবাদ সম্মেলনে মুহিতের ডান পাশে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আর বাঁ পাশে ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তাদের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থসচিব ড. মাহাবুব আহমেদ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান এবং পরিকল্পনা সচিব কাজী শফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা সত্যিই যদি অগ্রগতির পথে যেতে চাই, ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাই, তাহলে রাজস্ব আদায় অবশ্যই বাড়াতে হবে। আর সেই চ্যালেঞ্জই আমি আমার এই বাজেটে নিয়েছি। সেই চ্যালেঞ্জ সাকসেস করবো বলে আমি প্রত্যাশা করছি। চিনিতে ‘শুল্ক’ আরোপ ছাপার ভুল: নতুন অর্থবছরের বাজেটে চিনি আমদানির ওপর আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব ভুল করে ছাপা হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান। শুরুতে চিনির শুল্ক সম্পর্কিত এক প্রশ্নে রেগে যান অর্থমন্ত্রী। প্রমাণ সহকারে দ্বিতীয় দফা চিনির শুল্ক সম্পর্কিত বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দৃশ্যত বিরক্ত মুহিত মঞ্চে তার পেছনে বসা এনবিআর চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে বলেন, ইট শ্যুড নট বি দেয়ার। এটা কি করে হলো? এরপর এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, সাচিবিক সহায়তা দেয়ার সময় এ সমস্যা হয়েছে। রাজনৈতিক নির্দেশনায় ছিল যে বিষয়টা থাকবে না। বক্তৃতায় এটা ছিল না। পুরনো যে ছক ছিল এই ছকে এটা সংশোধনীর প্রয়োজন ছিল। এটা তখন করা যায়নি। সংসদ সচিবালয়ে ছক করে সংশোধনী দেব। ৮ই মে বাজেট বক্তৃতার আগেই এটা সংশোধন করা হবে। এনবিআর চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী বলেন, চিনির বিষয়টি অর্থবিলে থাকছে না। কর বৈষম্য থাকছে না: বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর সিটি করপোরেশন, জেলা সদরের পৌরসভা এবং অন্যান্য এলাকার করদাতাদের জন্য যথাক্রমে ৩ হাজার, ২ হাজার এবং ১ হাজার টাকা ন্যূনতম কর নির্ধারিত ছিল। এবারের নতুন বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৩০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ন্যূনতম কর বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তাই শহর ও গ্রামে করের বৈষম্য সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে কর বাড়ানোর প্রস্তাবে সংশোধনী আনার কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ন্যূনতম কর বাড়ানোর প্রস্তাবেও সংশোধনী আনা হবে। সব এলাকার জন্য চার হাজার টাকা ন্যূনতম করের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আর থাকবে না। সিটি করপোরেশনের জন্য আলাদা করা হবে। সংশোধনী আনা হবে। নতুন করদাতা বাড়ানো সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, ২০০৯ সালে আমি যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাই তখন দেশে সক্রিয় করদাতার সংখ্যা ছিলো সাত লাখ। এখন তা বেড়ে ১১ লাখ হয়েছে। ইট ইজ ভেরি ভেরি স্লো। এই সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আমাদের এনবিআর একটি জরিপ করেছে, সেই জরিপের ভিত্তিতেই আমরা নতুন করদাতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত এ কর আদায় করবো। সরকার কোনো চাল আমদানি করেনি: চাল আমদানির বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, সরকার কোন চাল আমদানি করেনি। ২০০৭-০৮ সালে যখন চালের ওপর থেকে শুল্ক উঠিয়ে দেয়া হলো তখন বেসরকারি খাত সুযোগ নিয়েছে। তারা কিছু কিছু চাল আমদানি করেছে। দেশের প্রয়োজনে সরকার কোন চাল আমদানি করেনি। কৃষি খাতে ভর্তুকি না বাড়ানোয় কৃষকের সাথে সরকারের শক্রতা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে কৃষিমন্ত্রী বলেন, মহাজোট সরকার কৃষকদের যেসব সুবিধা দিয়েছে অতীতের কোনো সরকার এত সুবিধা দেয়নি। কৃষিতে রপ্তানির ক্ষেত্রে নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। সেচযন্ত্রে বিদ্যুত সুবিধা ২০% রিবেট দিয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার ১১% থেকে কমিয়ে ৮% করা হয়েছে। ধান ও আলু রাস্তায় ফেলে দেয়ার বিষয়টি বিশেষ পরিস্থিতিতে ঘটেছিল। এখন আর ওই অবস্থায় নেই। আলু এখন স্বাভাবিকভাবে বিদেশে যাচ্ছে। কৃষি খাতে বরাদ্দের বিষয়ে অর্থ সচিব ড. মাহবুব আহমেদ বলেন, কৃষি খাতেও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। গত অর্থ বছরে কৃষি খাতে ১২ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছি। এ অর্থ বছরে তার চেয়ে বেশি অর্থাৎ ১২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

উচ্চাভিলাষী বাজেটের ব্যাখ্যায় শিল্পমন্ত্রী: উচ্চাভিলাষী বাজেটের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, জাতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য উচ্চাভিলাষী বাজেটের দরকার। দেশের কোন সেক্টর এখন পিছিয়ে নেই। পদ্মাসেতু বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আগে কোন ধরনের ভাতা দেয়াটা বাংলাদেশের জন্য কল্পনার বিষয় ছিল। এখন বহুক্ষেত্রে সরকার ভাতা দিচ্ছে। শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে বিসিক অঞ্চল সম্প্রসারিত হচ্ছে। রাতারাতি দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এটা দেখানো সম্ভব না। বাস্তবতার চেয়ে বেশি এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি।

বাজেট সম্পর্কে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু: বাজেট সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই বাজেটে চলমান অর্থনীতি জীবন যাত্রাকে সচল রাখতে যে বরাদ্দ দেয়া দরকার তাই দেয়া হয়েছে। ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছেন। ১০ হাজর মেগওয়াটের পরিকল্পনা কল্পনার পরিকল্পনা নয়। দেশী-বিদেশী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। আমরা গত ছয়টি বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারিনি। সরকার শতকরা ৯০-এর ওপরে সক্ষমতা অর্জন করেছে। তার মানে গোল্ডেন পাইনি কিন্তু জিপিএ-৫ পেয়েছি। রাজনৈতিক ঘাটতির মধ্যে গণতান্ত্রিক ঘাটতি নেই। যেটা আছে আগুন সন্ত্রাসের, জঙ্গিবাদের সন্ত্রাসের ঘাটতি আছে। আমেরিকা থেকে জাপান ও সৌদি আরব এ সমস্যা মোকাবিলা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছি, মোকাবিলা করছি। সুতরাং প্রশাসনের সেই সক্ষমতা রয়েছে। এখানেও আমরা জিপিএ-৫ পেয়েছি। আমি বাজেটে অর্থমন্ত্রীকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ দেব এবং রাজনৈতিক ঘাটতি মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সরকারকে জিপিএ-৫ দেব।

মোবাইলে কথা বলায় ট্যাক্স: মোবাইলে কথার বলার ওপর বেশি ট্যাক্স বসানোর কারণে দেশের তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, মোবাইল সিম কার্ডের ওপর ট্যাক্স কমানো হয়েছে। এটা ১০০ টাকায় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এদেশের মোবাইল সেক্টর অনেক দূর এগিয়েছে। তারা ভ্যাট ৫% অতিরিক্ত দিতে পারবেন। এ কারণেই ৫% বাড়ানো হয়েছে।

৯৫ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন: বাজেট বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, গতবছর ৯৫ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে। আমাদের দেশের উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটা সহজ না। আমাদের উন্নয়ন খাতে অপচয়রোধ করে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এডিপির আকার ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হয়েছে। এডিপি বাস্তবায়নে সফল হয়েছি। প্রবৃদ্ধির পরিমাণ লাফ দিয়ে আবার কমে যাক এটা আমরা চাই না। আমরা ধীরগতিতে ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে চাই। আঙ্গিক পরিবর্তন ও সংস্কার করেছি। বছরের চতুর্থভাগে প্রকল্প বাস্তবায়নের অভ্যেস থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে চাইছি।

প্রবৃত্তির ধারা রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন: প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশটা প্রায় সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেখানে অর্থনীতি প্রায় রাজনীতিকে ব্যাপক প্রভাবিত করে। তার প্রমাণ আপনারা গত জানুয়ারি মাসেই পেয়েছেন। অর্থনৈতিক ভিত্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেভাবে সবাইকে আবদ্ধ করেছে তার ফলে বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, জ্বালাও-পোড়াওয়ের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। এটা শেষ নয় চলবে। বেশিদিন এই অবস্থা সহ্য করতে হবে না। দেশে এই ধরনের যে প্রতিবাদ সেটা আর হবে না।

বাজেটে কালো টাকা প্রসঙ্গ না থাকার কারণ: এবারের বাজেট বক্তব্যে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে কিছু না থাকার কারণ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, আয়কর আইনে অপ্রদর্শিত আয় সম্পর্কে বিশদভাবে বলা হয়েছে। কিভাবে অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণা করে বৈধ করা যায় তা আইনে বলা হয়েছে। তাই এ বিষয়টি নতুন করে বাজেটে বিশেষ বক্তব্য রাখার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি না। এটা আগেও বলেছি, এখনও বলছি। অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের জমির দারুণ অভাব। অনেকেই বিনিয়োগ করতে চায় কিন্তু জমি পায় না। আমরা শুধুমাত্র এলাকা নির্দিষ্ট করে যোগাযোগ ও পাওয়ার সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করে দিই। বর্তমানে ৬টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এই বছরেই সেগুলো সম্পন্ন হবে বলে আশা করি। ১৫ বছরে মোট ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এবারের বাজেটে ৩০টির অনুমোদন দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যগুলোর জায়গা নির্দিষ্ট হয়েছে। ভারত, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া বড় বিনিয়োগ করতে চায়। এজন্য এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা করা হয়েছে।