হাফেজ মাহমুদের চিঠিতে পালানোর পরিকল্পনা

চুয়াডাঙ্গা থেকে ময়মনসিংহ আদালতে হাজিরার জন্য যাত্রাপথে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়ার প্রথম নকশা ছিলো

স্টাফ রিপোর্টার: ‘আমার হেয়ারিঙের ব্যাপারে আপনি জানতে চেয়েছেন। অবশ্য যেকোনো হেয়ারিঙের জন্য দুটি মাইক্রোবাস, দুটি মোটরসাইকেল, কিছু অস্ত্র ও দক্ষ কিছু লোকের প্রয়োজন। যারা ওই অস্ত্রগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারবে এবং এমন প্রচণ্ড মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে যে কাজ উদ্ধার না করে তারা ফিরবে না।’ জেএমবির আমির সাইদুর রহমানের (তখনো তিনি গ্রেফতার হননি) কাছে কারাগার থেকে এ চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন সংগঠনের শুরা সদস্য হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান। চিঠির ওপরে লেখার তারিখ ২০০৯ সালের ১৪ জুন উল্লেখ আছে। চিঠিতে চুয়াডাঙ্গা থেকে ময়মনসিংহ আদালতে হাজিরার জন্য যাত্রাপথে তাকে ছিনিয়ে নেয়ার এ পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছিলেন জেএমবির এ শীর্ষস্থানীয় নেতা। প্রথম পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে সাতক্ষীরার আদালতে নেয়ার পথে কাজটি করতে বলেছেন। এছাড়া মৌখিকভাবেও কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন বলে চিঠিতে ইঙ্গিত রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা মনে করছেন, কারাবন্দী হাফেজ মাহমুদ যে ২০০৯ সাল থেকেই পালানোর পথ খুঁজছিলেন, তার বড় প্রমাণ এ চিঠি। দ্বিতীয় চিঠিটিতে লেখার তারিখ ২১ জুলাই, ২০০৯ উল্লেখ রয়েছে। অন্যান্য কাগজপত্রের সাথে চিঠি দুটি জেএমবির আমির সাইদুর রহমানের ঢাকার ভাড়া বাসা থেকে ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর ৱ্যাব উদ্ধার করে। ওই বাসা থেকে সাইদুরের দ্বিতীয় স্ত্রী নুরুন্নাহার ও এক আত্মীয়াকে গ্রেফতার করে।

চিঠিতে কিছু কিছু সাঙ্কেতিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন অস্ত্রকে সামান, পুলিশকে জুনুদ, আদালতের হাজিরাকে মিটিং শব্দ দিয়ে। গ্রেফতারকে বলা হয়েছে অসুস্থতা, পুলিশ-ৱ্যাব অনুসরণ করাকে ভাইরাস লেগেছে এবং প্রোগ্রাম, দাওয়াত, তদবির বা হেয়ারিং শব্দ দিয়ে হামলা বা অভিযানের কথা বোঝানো হয়েছে। ২১ জুলাই (২০০৯) তারিখে জেএমবির আমিরকে লেখা চিঠিতে শুরুটা হলো মুহতারাম, কিছুদিন আগে আপনাকে আমার তদবির সম্পর্কে অবহিত করেছি। তদবিরের (আক্রমণ) কৌশল সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। আশা করি, তা যথার্থভাবে আপনার কাছে পৌঁছেছে। আমি জবাবের অপেক্ষায় আছি। যদিও জানি, আপনারা অনেক জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন। তবু অন্যান্য কাজের মধ্যেও আমার এ কাজ জরুরি। আমি যেসব পরামর্শ দিয়েছিলাম, তার মধ্যে যদি কোনো সমস্যা মনে করেন, তাহলে যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে আমাকে জানালে হয়তো বিকল্প উপায় বের করতে পারবো।’

হাফেজ মাহমুদ আরও বলেন, ‘আমি আগামী ২৯ জুলাই (২০০৯) চুয়াডাঙ্গায় মিটিং (আদালতে হাজিরা) করবো। তারপর আমার পরবর্তী গন্তব্য ময়মনসিংহ। সেখানে মিটিং ৩ আগস্ট। এজন্য ৩০ জুলাইয়ের পরে ২ আগস্টের মধ্যে যেকোনো দিন রওনা করবো। আর আপনারা যদি আমাকে আপনাদের প্রোগ্রামে নিয়ে যেতে চান (ছিনিয়ে নেয়া) তবে দীর্ঘ যাত্রাপথে সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমি যেদিন যাবো, সেদিন রওনা করবো সকাল সাতটা থেকে ১১টার মধ্যে। সবুজ রঙের একটা জিপ গাড়ি থাকবে আমার বাহন। যেসব জিপ আগের দিনে ইউএনও বা ম্যাজিস্ট্রেটরা ব্যবহার করতেন। তেমন পুরোনো মডেলের গাড়িই সাধারণত চুয়াডাঙ্গা থেকে আমাকে দেয়া হয়। কদাচিৎ শাদা মাইক্রো হয়ে থাকে। তাই সবুজ জিপে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সফরসঙ্গী থাকবে পাঁচ-ছয়জন জুনুদ (পুলিশ)। রওনা হওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ৩০ তারিখ থেকে ২ তারিখ পর্যন্ত একজনকে রাখতে পারেন গেটে (কারা ফটকে)।’

চিঠিতে আক্রমণের কৌশল বাতলে দিয়ে বলেন, কুষ্টিয়া-দাশুড়িয়া-বনপাড়া থেকে সিরাজগঞ্জ মোড়-এলেঙ্গা-মধুপুর-ময়মনসিংহ পর্যন্ত আপনাদের যেকোনো সুবিধাজনক স্থানে অপেক্ষা করতে পারেন স্বাগত জানানোর (আক্রমণের) প্রস্তুতি সহকারে। ওই স্থানে বাহন দাঁড় করানোর জন্য আগে থেকেই রাস্তায় ড্রেনের মতো খুঁড়ে বা মাটির স্পিড ব্রেকার বানিয়ে রাখতে পারেন। যাতে আমার বাহন ব্রেক করতে বাধ্য হয়। তারপর আমি যখন পৌঁছাবো, তখন ড্রেনের সামনে গাড়ি রাখতে হবে, যাতে ড্রাইভার অবস্থা প্রতিকূল দেখে গাড়ি টান না দিতে পারে। তারপর গাড়ি স্লো হওয়া মাত্র আপনার লোকেরা চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরবে। ড্রাইভারের পাশে বসা সুবেদারকে প্রথমেই আত্মসমর্পণ করাতে হবে। …সুবেদারের হাতে থাকে ছোট নাইন (নাইন এমএম পিস্তল) আর একটি চাইনিজ রাইফেল থাকবে আমার পার্শ্ববর্তী বসা হাবিলদারের হাতে। বাকিদের হাতেও থাকবে চাইনিজ রাইফেল। সফল হলে সেসব সামানও (অস্ত্র) আপনাদের হবে। আপনাদের হাতে একটা হাতুড়িও থাকতে হবে, যাতে দ্রুত জানালার গ্লাস ভাঙতে হবে।’

আদালতে যাওয়ার পথে সম্ভব না হলে ফেরার পথে চেষ্টা করার পরামর্শ দেন হাফেজ মাহমুদ। এ পথে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে আরেকটি পথ বাতলান এ জঙ্গি নেতা। তাহলো সাতক্ষীরা থেকে খুলনা রোডের মাঝখানে পাটকেলঘাটার পর শুভাসিনী কলেজের পূর্বে প্রায় দু-তিন কিলোমিটার পর্যন্ত রাস্তা অত্যন্ত খারাপ। সংস্কারকাজ চলছে, গাড়ি চলে অত্যন্ত ধীরে। এছাড়া মৌখিকভাবে একটি কৌশল সস্পর্কে বলা হয়েছে। আশা করি তা-ও আপনার জানা হয়েছে। সেটাও বিশেষ বিবেচনার জন্য ভেবে দেখবেন। মনে রাখবেন, এমন ধরনের একটি প্রোগ্রাম সফল হওয়ার মাধ্যমে বিক্রয়ের বহু পথ উন্মুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ।

হাফেজ মাহমুদ ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গার কারাগারে ছিলেন। সর্বশেষ ময়মনসিংহ আদালতে যাওয়ার পথে গত রোববার ত্রিশালে জঙ্গিরা প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশের এক সদস্যকে হত্যা করে হাফেজ মাহমুদসহ তিনজনকে ছিনিয়ে নেয়। অবশ্য চার ঘণ্টা পরেই হাফেজ মাহমুদ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং পরদিন ভোরে পুলিশের সাথে কথিত এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিনি নিহত হন।

জেএমবির ত্রিশাল অভিযানের ধরনের সাথে ওই চিঠি দুটিতে উল্লেখ করা পরিকল্পনার অনেক মিল আছে। জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাসিরউদ্দীন বলেন, জেএমবির কারাবন্দী নেতাদের ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা অনেক আগের। সংগঠন যখন সামর্থ্যবান হবে, তখন তারা সুযোগমতো সেটা বাস্তবায়ন করবে বলে তাদের সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে গত রোববার গ্রেফতারের পর হাফেজ মাহমুদ জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন।