হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ ৫ প্রস্তাব

মাথাভাঙ্গা মনিটর: বিরোধীদল দমনের পথ থেকে সরকারকে সরে আসতে বলার পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম থেকে দূরে থাকতে বিএনপিকে আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। গতকাল বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক প্রস্তাবে বাংলাদেশে বিবাদমান দু পক্ষকে সমঝোতায় এসে সঙ্কট সমাধানের আহ্বানও জানানো হয়েছে।

এক্ষেত্রে সম্ভাব্য সব কিছু এমনকি আগাম নির্বাচনের বিষয়েও ভাবতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ ৫ দফা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। গতকাল পেশ করা প্রস্তাবগুলো হলো- এক. বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। দুই. রাজবন্দিদের মুক্তি। তিন. জরুরি ভিত্তিতে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। চার. সহিংসতা বন্ধ। পাঁচ. র‌্যাব বিলুপ্ত ঘোষণা। অন্যদিকে বাংলাদেশে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টে। এর ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, সহিংসতার কারণে প্রতিদিন বাংলাদেশের জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের সদস্যরা। এতে বলা হয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের খেয়াল খুশিমতো গ্রেফতার করা হচ্ছে। এসব নেতাকে মুক্তি দেয়া উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের সংস্কৃতি থাকা প্রয়োজন। একই সাথে যেসব রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় তাদেরকে নিষিদ্ধ করা উচিত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টে বাংলাদেশে সমঝোতার জন্য সম্ভাব্য সব সহায়তা করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ইইউ’কে এমন একটি সমঝোতা প্রক্রিয়ায় সহায়তার সব চেষ্টা করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের নাগরিদের জনপ্রতিনিধি বেছে নেয়ার জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার থাকবে।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পেশ করা প্রস্তাবেও সংলাপ ও সমঝোতার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সহিংসতা বন্ধ ও বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করারও তাগিদ দেয়া হয়েছে উভয় প্রস্তাবে। গতকালই পৃথক ওই দু প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়েছে। হাউস অব কমন্সে পেশ করা প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিউ রবার্টসন জানিয়েছেন, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নতুন একটি নির্বাচনের জন্য নতুন সরকারসহ সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য এবং বিএনপির চেয়ারপারসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সাথে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার কথা বলেছেন, যাতে জরুরি ভিত্তিতে ভবিষ্যতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে একযোগে কাজ করার জন্য তাদের উৎসাহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, অর্ধেকের বেশি আসনে ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ না পাওয়ায় এবং অন্য বেশির ভাগ আসনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের মতো ব্রিটেনও হতাশ হয়েছে। সোমবার হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশের নির্বাচন, সহিংসতা ও নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি বিষয়ে বাংলাদেশ-বিষয়ক পার্লামেন্টারি গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান অ্যান মেইন সাতটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। স্থানীয় সময় গতকাল সকালে শুরু হওয়া আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচন, রাজনৈতিক সহিংসতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয় গুরুত্ব পায়। এদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে সাত দফার একটি প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে। গতকালই ওই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়েছে।  চার্লস ট্যানক, পাওয়েল রবার্ট কোয়ায়েল এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১. নির্বাচন কেন্দ্র করে সহিংসতা, বিশেষ করে নারী-শিশু, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করতে হবে। ২. সংঘাত-সহিংসতা বন্ধ করে সংকট উত্তরণের পথ বের করতে বাংলাদেশে সব পক্ষকে কার্যকর আলোচনায় বসার আহ্বান জানাতে হবে। ৩. সব পক্ষকে এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানাতে হবে, যাতে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পথ তৈরি হয়; স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয় এবং বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থকেই সবার আগে স্থান দেয়া যায়। ৪. ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার ও কারাবন্দি রাখার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করতে হবে এবং গুরুতর সহিংসতার ঘটনায় বিরোধী দলের (গত সংসদের) জড়িত থাকার কঠোর নিন্দা জানাতে হবে। ৫. গণগ্রেফতার বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে, যাতে সবাই শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন, জমায়েত হওয়া বা মত প্রকাশের অধিকার ভোগ করতে পারে। ৬. ঝুঁকিতে থাকা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তা বাড়াতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে। ৭. বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে একটি কার্যকর ব্যবস্থা তারা নেয়।

বাংলাদেশ বিষয়ক অল পার্টি পার্লামন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যান মেইন-এর উপস্থাপনায় হাউস বিতর্কে অংশ নেন বৃটিশ এমপি রেহমান চিশতি, জনাথন অ্যাসওর্থ, জেরেমি করবিন, মার্ক ফিল্ড এবং নিক ডি বয়িস। অ্যান মেইন তার বক্তব্যে বলেন, আমি বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলকে গণতন্ত্রের জন্য একসাথে বসে কাজ করার আহবান জানাই। নির্বাচনের আগে সিনিয়র মন্ত্রী সাঈদা ব্যারোনেস ওয়ার্সি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সমঝোতার জন্য সংলাপের তাগিদ দেন। কিন্তু এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয় নি। ২০০৬ সালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে অ্যান মেইন বলেন, ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করে। সে সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিলো। তখনকার চলমান বিক্ষোভ ও অস্থিতিশীল অবস্থায় সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে আস্থার অভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিলো। রেহমান চিশতি এমপি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় দলীয় সরকারের ওপর বিশ্বাসের অভাব থেকেই কয়েক বছর যাবত তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে। একই পদ্ধতি চালু আছে পাকিস্তানেও। তিনি বলেন, বাংলাদেশের দু নেত্রীর উচিত নিজেদের মধ্যে মত-পার্থক্য দূর করা। এসব ভুলে দেশ ও জনগণের স্বার্থকেই তাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তাদের কাজ করতে হবে। রানা প্লাজা ভবন ধসের কথা উল্লেখ করে নিক ডি বয়িস এমপি বলেন, রানা প্লাজার ভবন ধসের ঘটনার পর দেশটির কারখানার পরিবেশের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। জনাথন অ্যাসওর্থ এমপি বলেন, আমার জানামতে বাংলাদেশে বিশ্বের ২য় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস। আমরা বাংলাদেশকে সমর্থন করি। এখানেও প্রচুর বাংলাদেশী রয়েছেন। তাই তাদেরও উচিত সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও মানবাধিকার রক্ষা করা। মার্ক ফিল্ড এমপি বলেন, অনেকে বিস্ময় বোধ করতে পারেন আমরা কেন বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছি। বাংলাদেশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশের অন্যতম সদস্য। যুক্তরাজ্যেও অনেক বাংলাদেশি বাস করেন। দেশটির উন্নয়ন সহযোগিতায় অংশ নিই আমরা। এছাড়া প্রতিবিছর ১৫০ মিলিয়ন ডলার উন্নয়ন সহযোগিতা করে ডিএফআইডি। এ দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীরাই দেশটির স্থিতিশীলতা নিয়ে আমাদের কাছে জানতে চান। বিতর্কে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও তাতে সব দলের অংশগ্রহণ হয়নি। ভোটে অংশ নিতে পারেনি সব ভোটার। এতে বলা হয়, ২০০৬ সালের পর ২০১৩ সালে এসেও কার্যত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। দেশটির গণতন্ত্রের উন্নয়নে যুক্তরাজ্য সরকার যে সহায়তা দিচ্ছে তার ফলাফল খুবই দুঃখজনক।