হরিণাকুণ্ডু উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন খুন : ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ

দখলপুর বাজারে দিবালোকে ওত পেতে থাকা অস্ত্রধারীদের বোমা নিক্ষেপ ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসতা : বিজিবি মোতায়েনসহ ১৪৪ ধারা জারি

লাশ নিয়ে মিছিলে পুলিশি বাধা : ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলায় আগামীকাল বুধবার স্থানীয় বিএনপির ডাকে হরতাল

 

ঝিনাইদহ অফিস/হরিণাকুণ্ডু প্রতিনিধি: ঝিনাইদহ হরিণাকুণ্ডু উপজেলা বিএনপির সভাপতি দৌলতপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেনকে বোমা মেরে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। গতকাল সোমবার বেলা ১২টার দিকে দখলপুর বাজারে এ খুনের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতা বেশ কিছু দোকান ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। হরিণাকুণ্ডু আওয়ামী লীগ কার্যালয়ও ভাঙচুর করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন গতকাল সন্ধ্যা থেকে হরিণাকুণ্ডু শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে। ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলায় আগামীকাল বুধবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে বিএনপি। ঝিনাইদহে গতকাল লাশ নিয়ে মিছিল করতে গেলে পুলিশি বাধায় তা পণ্ড হয়ে যায়। তবে গোটা এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিহত আবুল হোসেন (৫৮) হরিণাকুণ্ডুর দৌলতপুর ইউনিয়নের মহারাজপুর গ্রামের মৃত আব্দুল গফুরের ছেলে।

Jhenidah 03

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিএনপি নেতা ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন সকাল ১১টার দিকে দলীয় কার্যক্রম শেষে ইউপি কার্যালয়ে যান। সেখান থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মোটরসাইকেলযোগে মহারাজপুর গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে দখলপুর বাজারে ব্রিজের নিকট পৌঁছুলে ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে দুটি বোমা ছুড়ে মারে। বোমার প্লিন্টারে তিনি মোটরসাইকেল থেকে আছড়ে পড়েন। এরপর সন্ত্রাসীরা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় রিশখালী, দখলপুর, সাতব্রিজ, পার্বতীপুর বাজার প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌছায়। লাশ উদ্ধার করে ঝিনাইদহ হাসপাতালমর্গে নেয়ার প্রক্রিয়া করে। বিক্ষুব্ধ জনতা স্থানীয় দোকানপাট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা এলাকা ভয়াবহ অবস্থায় রূপ নেয়। হরিণাকুণ্ডু উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ বিএনপি নেতা-কর্মীরা। এ সময় শহরের উপজেলা মোড়, হলবাজার ও দখলপুর বাজারের অন্তত ৩০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। বেশ কিছু সোনার দোকান লুটপাট হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সহিংসতা এড়াতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়। ঝিনাইদহের সহকারী পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম জানান, সন্ত্রাসীরা বিএনপি নেতাকে কুপিয়ে ও বোমা মেরে হত্যা করেছে। ঘাতকচক্রকে শনাক্ত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু হয়েছে।

হরিণাকুণ্ডু উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. এমএ মজিদ জানান, হরতালবিরোধী আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে বোমা মেরে ও কুপিয়ে বিএনপি নেতা আবুল হোসেনকে হত্যা করেছে। তিনি অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতার দাবি করেন। এ ব্যাপারে হরিণাকুণ্ডু উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মশিউর রহমান জোয়ার্দ্দার বলেন, এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয়। নিহত আবুল হোসেন দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলো। সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করে থাকতে পারে বলে তিনি দাবি করেন। আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান জোয়ার্দ্দার, আজগর মাস্টার ও বুড়ো মেম্বারের নেতৃত্বে ১৫/২০ সন্ত্রাসী এ হামলা চালিয়েছে বলে বিএনপি নেতাকর্মীরা মৌখিকভাবে অভিযোগ তোলেন।

এদিকে বিএনপি নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে জেলা বিএনপি বিকেলে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। জেলা বিএনপির সভাপতি কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মসিউর রহমান জানান, আগামীকাল বুধবার ঝিনাইদহের ৬ উপজেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয়া হয়েছে। হত্যার প্রতিবাদ ও ঘাতকদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে এ হরতাল পালন করা হবে। এদিকে গতকাল সন্ধ্যার পর অজ্ঞাত স্থান থেকে দৈনিক মাথাভাঙ্গা দফতরে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তি নিজেকে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি লাল পতাকার দেবাশীষ বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, আবুল চেয়ারম্যান আমাদের পার্টি বিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলো বলে খতম করা হয়েছে।

বিজিবি মোতায়েনের পর এবার পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শহরে মাইকিং করেছে। এদিকে বোমা হামলায় নিহত হরিণাকুণ্ডু উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হোসেনের লাশ নিয়ে ঝিনাইদহ শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জেলা বিএনপি। তবে পুলিশি বাধায় মিছিলটি পণ্ড হয়ে যায়। সদর হাসপাতাল থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি শহরের হামদহ এলাকায় পৌঁছুলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে সেখানে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক, যুগ্মসম্পাদক এমএ মজিদসহ নেতাকর্মীরা বক্তব্য রাখেন।

আমাদের জামজামি ও ডাকবাংলা প্রতিনিধি ঘটনাস্থল এবং নিহতের বাড়ি থেকে ফিরে জানান, বিকেলে ঝিনাইদহ হাসপাতালমর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতরাতে লাশ তার নিজ বাড়িতে নেয়া হয়। নিকটজনদের কান্না আর ক্ষোভে এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। আজ মঙ্গলবার দাফন সম্পন্ন করা হবে। পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, গতকাল সোমবার সকালে বাড়িতে নাস্তা করেন। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার কথা বলেই বাড়ি থেকে বের হন। তিনি একটানা ৩ দফা দৌলতপুর ইউপির নির্বাচিত চেয়ারম্যান। গত ইউপি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী আ.লীগের মহাম্মদ আলী (বুড়ো মেম্বার-সাবেক) তার দলবল লেলিয়ে দিয়ে এ খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। দখলপুর গ্রামের কাঙ্গালের ছেলে অস্ত্রধারী মিন্টু, বারেকের ছেলে সালাম. এরশাদ আলীর ছেলে আজগর মাস্টারসহ দখলপুর পারদখলপুর গ্রামের প্রায় ১৯জনকে আসামি করে মামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে নিহতের পরিবারের কয়েক সদস্য জানান। নিহত আবুল হোসেনের স্ত্রী মোছা. পারুলা খাতুন, এক ছেলে সাইদুর রহমান যশোর ইস্টার্ন ব্যাংকের সেকেন্ড অফিসার ও সাইফুর রহমান সার ডিলার। ছোটো ছেলে আসাদুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।

স্থানীয়রা বলেছে, ২০০৫ সালের ১৯ অক্টোবর তৎকালীন বিএনপির সভাপতি হরিণাকুণ্ডু পৌর চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মণ্ডলকে খুন করে সন্ত্রাসীরা। তখন ছিলো রমজান মাস। থানা মসজিদে তারাবিহ পড়তে যাওয়ার প্রাক্কালে থানার গেটের পাশেই তাকে ব্রাশফায়ার করে কয়েকজন অস্ত্রধারী। এরপর প্রায় পৌনে একযুগ ধরে আবুল হোসেন হরিণাকুণ্ডু উপজেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি ছিলেন ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সহসভাপতি।