স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান অনুতপ্ত দুই নারী জঙ্গি

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর আশকোনার জঙ্গি আস্তানা থেকে আত্মসমর্পণকারী দুই নারী এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। তারা অনুতপ্ত, মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে চান। রিমান্ডে থাকা দুই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা এই তথ্য জানিয়েছেন। দুই নারী জেবুন্নাহার (শিলা) ও তৃষা মণিকে গতকাল সোমবার দ্বিতীয় দফায় ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। কর্মকর্তারা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদের শুরু থেকেই তৃষা মণি তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করছিনে। নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার প্রথম দিকে জিজ্ঞাসাবাদে মুখ না খুললেও এখন কথাবার্তা বলছেন। তারা দুজনই স্বামীর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন। এখন ভুল বুঝতে পারছেন। দুজনই পুলিশকে বলেছেন, জঙ্গি আস্তানাগুলো ছিল কারাগারের মতো। তাঁরা বাইরের কারও সঙ্গে মিশতেন না, কথাবার্তাও বলতেন না। তাঁদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি ছিলো। জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম থেকেই জঙ্গি মাইনুল ইসলাম মুসার স্ত্রী তৃষা মণি পুলিশকে সহযোগিতা করছিলেন। এখন জেবুন্নাহার শিলাও সহযোগিতা করছেন।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, জেবুন্নাহার জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তাঁর স্বামী মেজর জাহিদ আগে থেকে ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু উগ্রপন্থী ছিলেন না। জাহিদ ২০১৪ সালে কানাডায় যান একটা প্রশিক্ষণে। ফেরার পর কট্টর হতে থাকেন। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর রেশন নেওয়া বন্ধ করেন। জাহিদ সেনাবাহিনী থেকে চাকরি ছাড়ার প্রস্তুতি নেওয়া সময় থেকেই জেবুন্নাহারকে উগ্র মতাদর্শের বিভিন্ন বই পড়ে শোনাতে শুরু করেন। একপর্যায়ে জেবুন্নাহার জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন এবং ‘জিহাদ’ করে বেহেশতে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের শুরুর দিকে জেবুন্নাহার খুব শক্ত ছিলেন। কখনো কখনো তাকে নিজ বিশ্বাসে মরিয়া মনে হয়েছিল। পরে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে। এখন তিনি বলছেন, কৃতকর্মের জন্য তিনি অনুতপ্ত। তিনি বেঁচে থাকতে চান। তাঁর ছোট ছোট দুটি মেয়ে আছে। বাড়িতে মা–বাবা আছেন। তাঁদের কাছে যেতে চান, সন্তানদের কাছে পেতে চান। জেবুন্নাহার শিলার মা জোহরা খাতুন গতকাল বলেন, ‘আমার মেয়ে খুব বিলাসী জীবনযাপন করেছে। সেই মেয়ে এখন রিমান্ডে। কোলের বাচ্চাটা কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে। জাহিদই আমার মেয়েটার সর্বনাশ করেছে।’ তিনি বলেন, তাঁর কাছে থাকা জেবুন্নাহারের বড় মেয়েটা প্রায় প্রতি রাতে মায়ের জন্য কাঁদে। সে ডিবি অফিসে একবার মাকে দেখে আসার পর এখন জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে থাকে। মাকে দেখতে যাওয়ার বায়না করে। তদন্তেযুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীর সঙ্গে মেজর জাহিদের যোগাযোগের বিষয়টি জেবুন্নাহার জানতেন, তবে ব্যক্তিগতভাবে তামিমকে চিনতেন না বলে রিমান্ডে জানিয়েছেন। তবে জেবুন্নাহার গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার খবর জানতেন। তিনি এও জানতেন যে তাঁর স্বামী জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। জেবুন্নাহার পুলিশকে জানান, গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার রূপনগরে পুলিশের অভিযানে জাহিদের নিহত হওয়ার খবর তিনি সংবাদমাধ্যমে জানতে পারেন। ওই ঘটনার সপ্তাহ দু-এক আগে তাঁরা আজিমপুরে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসার স্ত্রী তৃষা মণির সন্তান হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসায় জেবুন্নাহার বড় মেয়েকে আজিমপুরে তানভীর কাদেরী ও আবেদাতুন ফাতেমার কাছে রেখে আশকোনার আস্তানায় চলে আসেন।
তৃষা মণির বাবা আবদুস সামাদও তার মেয়ের এই দশার জন্য জামাতা মাইনুল ইসলাম মুসাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, প্রায় সাত মাস তার সঙ্গে মেয়ের কোনো যোগাযোগ হয়নি। ঢাকার আশকোনার সূর্য ভিলায় অভিযান শুরুর পর রাত সাড়ে তিনটার (২৩ ডিসেম্বর) দিকে তৃষা তাঁকে ফোন করে বিপদের কথা জানায়। তার একটু পরই ফোনের লাইন কেটে যায়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রিমান্ডে তৃষা বলেছেন, স্বামী মাইনুলের প্ররোচনায় তিনি জঙ্গিবাদে জড়ান। তবে তিনি কখনো দেশের মানুষকে হত্যা করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তৃষার দাবি, তিনি বেশ কয়েকবার জঙ্গি আস্তানা থেকে পালানোর চেষ্টাও করেছেন। সর্বশেষ স্বামীর আরেকটি বিয়ে করার সিদ্ধান্তে পাঁচ মাস বয়সী কন্যাসন্তানের মা তৃষা মণি ক্ষিপ্ত ছিলেন। তৃষা যেকোনো সময় বেঁকে বসতে পারেন, স্বামী মুসার এই আশঙ্কা ছিল বলেও জিজ্ঞাসাবাদে তৃষা বলেছেন।