স্থল সীমান্ত বিল ভারতের মন্ত্রিসভায় অনুমোদন : শেষ হচ্ছে ৬৮ বছরের প্রতীক্ষা

স্টাফ রিপোর্টার: শেষ পর্যন্ত আসামকে রেখেই বহুল আলোচিত বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল অনুমোদন করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এই বিল আজ বুধবার ভারতের রাজ্যসভায় তোলা হচ্ছে। রাজ্যসভায় পাসের পর আগামীকাল বৃহস্পতিবার লোকসভায় পাস করানোর কথা রয়েছে।

1430845021

বিজেপি ও কংগ্রেসের মতৈক্যের ভিত্তিতেই পার্লামেন্টে বিলটি পাসের সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায় চুক্তি নিয়ে দু দেশের মধ্যে চলা দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন অবসান হতে যাচ্ছে। অবশেষে ৬৮ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান হতে যাওয়ায় আনন্দে ভাসছে উভয় দেশের ১৬২ ছিটমহলের নাগরিকরা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রচার হওয়ার পরই উল্ল­সিত হয়ে ওঠে তারা। তাত্ক্ষণিকভাবে তারা মিষ্টি বিতরণ করে।

সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ভারতীয় পার্লামেন্টে সীমান্ত বিলটি চূড়ান্তভাবে পাস হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরসূচি চূড়ান্ত হবে। জুন মাসে নরেন্দ্র মোদী ঢাকা আসবেন বলে কূটনৈতিক সূত্র জানায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলেই দু দেশের সীমান্ত নিয়ে প্রায় সাত দশক ধরে চলে আসা সমস্যার সমাধান হচ্ছে। এক্ষেত্রে নতুন ইতিহাসের সূচনা করছেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে সীমান্তবর্তী দুই জনপদের মানুষের মধ্যে জমি, ভিটেবাড়ি নিয়ে জটিলতার সূচনা ঘটে, যার অবসান হতে চলছে।

গত এক সপ্তার বেশি সময় ধরে সীমান্ত চুক্তি বিল নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি পার্লামেন্টে পাস হবে কি-না তা নিয়েও নানা জল্পনা-কল্পনা চলছিলো। এর কারণ ছিলো আসামকে চুক্তি থেকে বাদ রাখার সরকারি পরিকল্পনা। আসাম বিজেপির আপত্তির কারণেই আসামকে বাদ রেখে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল রাজ্যসভায় তুলতে চেয়েছিলো মোদী সরকার। কিন্তু আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ও বিরোধীদল কংগ্রেসের আপত্তির মুখে সরকার এ সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। স্থল সীমান্ত চুক্তিতে আসামকে যুক্ত করেই সংবিধান সংশোধনী বিল ভারত সরকার অনুমোদন করেছে। গতকাল সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংবিধান সংশোধনী খসড়া বিল অনুমোদন করা হয়।

গত সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত চলা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকে আসামকে যুক্ত করেই পার্লামেন্টে স্থল সীমান্ত বিল উত্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ’র আহ্বানে বিজেপি নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অমিত শাহ’র বাসভবনে অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, সংসদীয় মন্ত্রী ভেংকাইয়া নাইডু, ক্রীড়ামন্ত্রী সোনওয়াল, বিজেপি’র সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবসহ আসাম বিজেপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সাংবাদিকদের জানান, গত দুই দিন ধরে বিজেপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন লক্ষ্যে সংবিধান সংসদীয় বিল নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা তরুণ গগৈর প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠি ও বিরোধীদল কংগ্রেসের আপত্তির কথা তুলে ধরা হয়। এরপর গত কংগ্রেসের আমলে যেভাবে রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপন করা হয়েছে সেভাবেই পাসের জন্য উত্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর আজ বুধবার সীমান্ত বিলটি অপরিবর্তিতভাবে রাজ্যসভা এবং কাল বৃহস্পতিবার লোকসভায় পাস হতে পারে। পার্লামেন্টে এই সংবিধান সংশোধন বিল পাসে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে। স্থল সীমান্ত সংক্রান্ত আগের একটি বিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ঝুলে আছে।

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে এ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল স্বাক্ষর করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মনমোহন চুক্তিটি সই করেন। কিন্তু এর বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন এখনো না হওয়ায় ব্যাপারটি ঝুলে রয়েছে।

দু দেশের মধ্যে ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় এবং সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করাই এ স্থল সীমান্ত চুক্তির লক্ষ্য। সাড়ে ৬ কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিত করা হবে। ছিটমহলগুলোর মধ্যে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি (৭১১০ একর জমি) এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি (১৭১৬০ একর) জমি বিনিময় হবে। অপদখলীয় জমির মধ্যে মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অধীন সীমান্তে ২০০০ একর জমি এবং আসামের ২৬৮ একর জমির অধিকারী হবে বাংলাদেশ।

চুক্তি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সম্ভাব্য ঢাকা সফরের পালেও হাওয়া লেগেছে। কারণ নরেন্দ্র মোদী চাইছিলেন, এই বিল পাসের পর জুন মাসে বাংলাদেশ সফরে আসতে। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ঢাকা ও নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা মে মাসের শুরুতে ভারতের পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধন বিল পাসের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর দিনক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করার কথা।

মন্ত্রিসভায় বিলের অনুমোদনকে স্বাগত জানিয়েছেন সিপিআই এমপি ডি. রাজা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেস সরকারের আমলে স্থল সীমান্ত চুক্তি সংশোধনী বিল ভারতের উভয় সংসদে উত্থাপনের বিরোধিতা করলেও এখন তিনি তার মত পরিবর্তন করে এ বিল পাসের পক্ষে মত দিয়েছেন।

ফিরে দেখা: ছিটমহল হচ্ছে কোনো দেশের মূল ভৌগোলিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য একটি দেশের মূল ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে বিরাজমান ভূখণ্ড বা জনপদ। ছিটমহল থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ওখানে যেতে হলে অন্য দেশটির জমির ওপর দিয়ে যেতে হয়। এসব ছিটমহল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় এবং সীমানার ওপারে ভারতের কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। কোচরাজারা এবং রংপুরের মহারাজারা মূলত ছিলো সীমান্ত। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনকি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও মহলের বিনিময় হতো। মোগল আমলে প্রতিদ্বন্দ্বী এ দু ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা ও মহারাজারা মিলিত হতো তিস্তা পাড়ে দাবা ও তাস খেলার উদ্দেশে। খেলায় বাজি ধরা হতো বিভিন্ন মহল নিয়ে, যা কাগজের টুকরা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। খেলায় হার-জিতের মধ্যদিয়ে এ কাগজের টুকরা বা ছিট বিনিময় হতো। সাথে সাথে বদলাতো সংশ্লিষ্ট মহলের মালিকানা। এভাবে সেই আমলে তৈরি হয়েছিলো এক রাজ্যের ভেতরে অন্যের ছিটমহল। অপরদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অনেক স্থানে দু দেশের বাসিন্দারা সীমান্তরেখা ছাড়িয়ে গিয়ে ভূমি দখল করে রেখেছে বছরের পর বছর। যাদের দখলে আছে তারা এসব বিরোধপূর্ণ স্থানে কৃষিকাজও করছে। এখন এসব ভূমি বহু বছর ধরে যে দেশ দখল করে রাখছে তাদের কাছে ছেড়ে দিয়ে অপদখলীয় ভূমির হস্তান্তর হবে চুক্তি বাস্তবায়ন হলে। এক্ষেত্রে রেডক্লিফের সীমান্ত রেখারও পরিবর্তন হচ্ছে- যার ফলে নতুন গুচ্ছ মানচিত্র তৈরি করেছেন দুই দেশের জরিপ কর্মকর্তারা। অপদখলীয় ভূমিগুলোও বিনিময় করা হবে, যার ফলে ভারত প্রায় দু হাজার আটশ একর জমি পাবে। আর বাংলাদেশকে দিতে হবে দু হাজার দুইশ ষাট একরের মতো জমি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থল সীমান্ত রয়েছে। এ দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে তিনটি স্থানে সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা এখনও অচিহ্নিত রয়েছে। এ স্থানগুলোতে বিরোধপূর্ণ এলাকা দিয়ে প্রায়ই সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখন সীমানায় যে স্থান যার দখলে রয়েছে সেখানেই সীমান্ত রেখা টেনে গুচ্ছ মানচিত্র করা হয়েছে।