স্ত্রী ঘরে তালাবন্দী ৪৩ বছর- যেন আরেক লালসালু!

 

স্টাফ রিপোর্টার: সে অনেক বছর আগের কথা, ‘লালসালু’তে স্বামীর ধর্মের নামে ব্যবসা ও ধর্মীয়কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে মজিদের ছোট স্ত্রী জমিলাকেনির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিলো।কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও মূল্যবোধের উৎকর্ষের যুগেও মজিদরূপী কেউকেউ আমাদের সমাজে আছে যে তার স্ত্রীদের বছরের পর বছর শিকলে বন্দী করেরেখেছে। উপযুক্ত পাত্রের অভাবেমেয়েদের বিয়ে দেয়নি। এরা লেখাপড়া করতেপারেনি। কতোদিন সূর্যের আলোয় আসেনি তার ঠিক নেই। তারা এখন ভারসাম্যহীন। চোখেউদ্ধারের সকরুণ প্রার্থনা।

ধর্মের নামে এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে বছরের পর বছর শিকলেবন্দী জীবনযাপন করছে তারই ছাট স্ত্রী। স্বামীর অত্যাচর সহ্য করতে না পেরেঘর ছেড়ে পালায় বাগেরহাটের খানকা শরীফের খাদেম শেখ নুর মোহাম্মদের ছোটস্ত্রী পারভীন আকতার। পরে নুর মোহাম্মদ তার মুরিদদের সহযোগিতায় ওই স্ত্রীকেধরে এনে শিকলে বন্দী করে রাখেন।তবে এর আগে নুর মোহাম্মদ বিয়ে করেন কুলসুম বেগমকে। তিনি ৪৩ বছর তার সাথেসংসার করছেন। কিন্তু পর্দার দোহাই দিয়ে ৪৩ বছরই তার স্বামী তাকে ঘরেতালবদ্ধ করে রেখেছে।কুলসুম বেগমের ছেলে বাকি বিল্লাহ তার বাবার এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেপ্রতিবাদ করে দু মাকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য গত ২৬ জুন বাগেরহাটপুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ পেয়ে বাগেরহাট পুলিশসুপার নিজামুল হক মোল্লা সরেজমিনে ঘটনা তদন্তে পাঠান বাগেরহাট সদরের সহকারীপুলিশ সুপার সাদিয়া আফরোজকে।তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পান।

বাকি বিল্লাহর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, তার বাবার (বাগেরহাটের খানকাশরীফের পীর দাবিকৃত খাদেম শেখ নুর মোহাম্মদ) দুই স্ত্রী। তিনি কখনও তাদেরঘরের বাইরে বের হতে দেন না। সবসময় ঘরের বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখেন।বিভিন্ন সময় তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালান। শরীরে অলঙ্কার তোদূরের কথা প্রয়োজনীয় জিনিসও দেন না।বাইরের কাউকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেননা। কোন আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও দেন না।এছাড়া তার বোনদের সঙ্গে তাদের দেখা করতে দেন না। ঘরের বাইরে যেতে পারে না।লেখাপড়ার সুযোগ তাদের দেয়া হয়নি। তার বড় বোন ফতেমা আকতারের বয়স প্রায় ৩৫।তিনিসহ তার আরেক বোন ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েফেলেছেন। বাবার মতো, পর্দায় রাখবে এমন ছেলে না পাওয়ায় তার বড় দু বোনের আজওবিয়ে দেয়া হয়নি।
লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, তাঁর ছোট মা একবার পালিয়েছিলো। পরে তাকেমুরিদদের সহযোগিতায় ধরে এনে শিকলে বন্দী করে রাখে। তার বাবার অনেক মুরিদআছে। এর আগের পুলিশ সুপার বাকি বিল্লাহর এক বোনকে উদ্ধার করে বিয়ে দেয়ারকারণে তার বাবা তার মুরিদদের প্রভাব খাটিয়ে ওই পুলিশ সুপারকে বদলির হুমকিদিয়েছিল। তার বাবা ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে মুরিদদের কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায়করে থাকে।

বাগেরহাট (সদর) সহকারী পুলিশ সুপার সাদিয়া আফরোজ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেবলেন, তিনি ২৯ জুন ওই বাড়ি গিয়েছিলেন। বাড়ি ঢুকতে তার চোখে পড়ে একটি ঘরেবসে আছে নুর মোহাম্মদের কয়েক মুরিদ। বাড়িটি দুই রুমের। রুমে কোন জানালানেই। একরুমে বাতিও নেই। নেই কোন আসবাবপত্র। বাইরে থেকে রুমে তালাবদ্ধ থাকে।রুম দুটি বসবাসের একেবারেই অনুপোযোগী।সাদিয়া আফরোজকে পেয়ে নুর মোহাম্মদের বড় স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েন এবংস্বামীর নির্যাতনে বর্ণনা দেন। বড় স্ত্রী তাকে জানান, সে বিয়ের পর থেকে ৪৩বছর তালাবদ্ধ অবস্থায় আছেন।
সাদিয়া আফরোজ নুর মোহাম্মদের ছোট স্ত্রীর বরাত দিয়ে জানান, সে যাওয়ার আগেনুর মোহাম্মদ ছোট স্ত্রীকে হুমকি দিয়ে বলেছে, পুলিশের কাছে কিছু বললে জবাইকরেদেবে।নুর মোহাম্মদের ছেলে বাকি বিল্লাহ এ প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরেফোন করে জানান, পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেয়ায় তার বাবা ক্ষিপ্ত হয়েছেন।তাঁর মাদের নিকট থেকে তারা কোন স্বীকারোক্তি দেননি এই মর্মে লিখিত নেয়ারচেষ্টা চালাচ্ছে।বাকি বিল্লাহ তাঁর বাবার হাত থেকে দুই মা ও বোনদের রক্ষার দাবি জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে নুর মোহাম্মদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার মোবাইলে ফোন করা হলেসাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন। তবে বাগেরহাট পুলিশ সুপার নিজামুল হকমোল্লা জানিয়েছেন, তিনি নুর মোহাম্মদকে ডেকেছিলেন, তিনি পুরো বিষয়টিঅস্বীকার করেছেন। তবে এ সময় ওই ওয়ার্ডের কমিশনার তার পক্ষে কথা বলতেএসেছিলো।বাগেরহাট পুলিশ সুপার আরও বলেন, এটা একটা ব্যাধি। তাদের উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু তাদের উদ্ধার করার পর তাদের দায়িত্ব কে নেবে?