সোলেমানি হত্যার প্রতিশোধ: হোয়াইট হাউসে হামলার হুমকি ইরানের

জানাজায় জনতার ঢল : অঝোরে কাঁদলেন খামেনি: মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সেনা তাড়ানোর হুঙ্কার

স্টাফ রিপোর্টার: শোকে-ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানি কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে হত্যার পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। সোলেমানিকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে হোয়াইট হাউসে হামলার হুমকি দিয়েছে ইরান। পুরো মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাঘাঁটি এবং সৈন্য উচ্ছেদের হুঙ্কার দিয়েছেন সোলেমানির স্থলাভিষিক্ত কুদস বাহিনীর নতুন প্রধান ইসমাইল কানি।
এরই মধ্যে মার্কিন সেনা উৎখাতের বিষয়ে রোববার রাতে একটি প্রস্তাব পাস করেছে ইরাকের পার্লামেন্ট। জবাবে বাগদাদের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে তেলআবিবসহ যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি লক্ষ্যে তেহরানের হামলা পরিকল্পনার জবাবে তাদের ৫২টি স্থাপনায় হামলার হুমকি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দু’দেশের এ পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধমকির মধ্যে পরমাণু চুক্তি প্রত্যাহার করেছে ইরান।
গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সোলেমানিসহ তার সহযোদ্ধাদের জানাজা হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি জানাজায় ইমামতি করেন। একপর্যায়ে তাকে অঝোরে কাঁদতে দেখা গেছে। তেহরান এদিন জনসমুদ্রে পরিণত হয়। তার জানাজায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ নিহত কমান্ডারের ছবি নিয়ে জানাজায় যোগ দিতে এসেছিলেন। ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এ নেতার লাশ শোকাহত জনগণের কাঁধে চড়ে প্রায় ৬ মাইল দূর থেকে জানাজাস্থলে আসে। ক্ষুব্ধ এ জনগণ সোলেমানির হত্যাকারী ট্রাম্পের মাথার মূল্য ৮ কোটি ডলার ঘোষণা করেছে।
‘আমেরিকা নিপাত যাক, সৌদি আরব- ইসরাইলের পতন হোক’- স্লোগানে কেঁপে ওঠে তেহরান। জানাজার ঠিক আগ মুহূর্তে জাতির উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন সোলেমানির মেয়ে জয়নব সোলেমানি। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘উন্মাদ ট্রাম্প, বাবার মৃত্যুতে কোনো কিছুই শেষ হয়ে যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের জন্য কালোদিন অপেক্ষা করছে।’
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস বাহিনীর প্রধান সোলেমানিকে হত্যার পর চরম প্রতিশোধের হুমকি দেয় ইরান। তার স্থলাভিষিক্ত ইসমাইল কানি সোমবার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব সেনাঘাঁটি এবং সৈন্যদের হঠিয়ে দেয়াই হবে আমাদের চরম প্রতিশোধ। আমাদের সব শক্তি দিয়ে শহীদ সোলেমানির দেখানো পথে চলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। এ অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপে তার শাহাদতের প্রতিশোধ নেয়া হবে।’
এর আগে রোববার সন্ধ্যায় মার্কিন সেনাদের দেশ থেকে বের করে দিতে একটি প্রস্তাব পাস করে ইরাকের পার্লামেন্ট। পার্লামেন্টে পাস হওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সরকারকে যে কোনো বিদেশি সেনা ইরাকে অবস্থানের ইতি অবশ্যই টানতে হবে। বিদেশি সেনাদের কোনো কারণেই ইরাকের মাটি, আকাশ ও নৌপথ ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না।’
আরও বলা হয়, আইএসবিরোধী যুদ্ধে সহায়তার জন্য ইরাকি সরকার বহুজাতিক বাহিনীর প্রতি যে অনুরোধ জানিয়েছে, তা ফেরত নিতে হবে। জবাবে বাগদাদের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। রোববার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে রাজধানী ওয়াশিংটন যাওয়ার পথে ‘এয়ারফোর্স ওয়ানে’ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সেখানে আমাদের অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি বিমান ঘাঁটি আছে। যা নির্মাণ করতে শত শত কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। এর মূল্য পরিশোধ না করা পর্যন্ত আমরা সেখান থেকে সরছি না।’ প্রসঙ্গত, শুক্রবার সকালে বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন ড্রোন হামলায় কাসেম সোলেমানিসহ সাতজন নিহত হন। এর পরপরই প্রতিশোধের ডাক দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন ইরান, ইরাকের শিয়াপন্থীরা।
সোলেমানির জানাজায় জনতার ঢল, অঝোরে কঁদলেন খামেনি: গতকাল সোমবার সোলেমানির জানাজা উপলক্ষে রাজধানী তেহরানের সড়কগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছিলো। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি জানাজায় ইমামতি করেন। জানাজার নামাজ চলার একপর্যায়ে তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে দেখা গেছে। রোববার সোলেমানির লাশ ইরাক থেকে ইরানে আনা হয়। গত শতকের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় থেকে সোলেমানিকে জাতীয় বীর হিসেবে দেখেন ইরানিরা। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা খামেনির পর তিনিই সবচেয়ে ক্ষমতাবান ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
শোকার্ত লোকজন তাদের মাথার ওপর দিয়ে সোলেমানির কফিন এগিয়ে দেয়ার সময় ‘আমেরিকা নিপাত যাক’, ‘ইসরাইল নিপাত যাক’ বলে স্লোগান দেয়। প্রায় ৬ মাইল পথ শোকাহত জনগণের কাঁধে চড়ে এসেছে ইরানের এ কৃতিসন্তানের লাশ। জানাজার পর সোলেমানির কন্যা জয়নব সোলেমানি এক ভাষণ দেন। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জানাজা শেষে সোলেমানিসহ নিহত সবার কফিন তেহরানের ইনকিলাব চত্বরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকে কফিনগুলো ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে আজাদি স্কয়ারে নেয়া হবে বলে তেহরান টাইমস জানিয়েছে। সেখান থেকে সোলেমানির মরদেহ শিয়াপন্থী ইসলামের অন্যতম কেন্দ্রস্থল কোম নগরীতে নিয়ে যাওয়া হবে। কোমে জানাজা শেষে তার মরদেহ মঙ্গলবার নেয়া হবে জন্মস্থান কেরমান প্রদেশে। তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী সেখানেই হবে দাফন।
হোয়াইট হাউসে হামলার হুমকি ইরানি এমপির: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাসভবন হোয়াইট হাউসে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছেন এক ইরানি এমপি। রোববার সন্ধ্যায় আবুল ফজল আবুতোরাবি নামের ওই এমপি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই জেনারেল কাসেম সোলেমানির হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে ইরান।
তিনি বলেন, ‘আমরা হোয়াইট হাউসেও হামলা চালাতে পারি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে তাদের যোগ্য জবাব দিতে পারি। আমাদের সেই ক্ষমতা আছে এবং আল্লাহ চাইলে আমরা সময়মতো এর জবাব দেবো।’
ব্রিটিশ সেনাদেরও হত্যার হুমকি তেহরানের: মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ সেনাদের হত্যা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে তেহরান। সোলেমানি হত্যাকা-ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ট্রাম্পকে সমর্থন করায় সোমবার এক বিবৃতিতে ব্রিটিশ সেনা হত্যার এ হুমকি দেন ইরানের এক সিনিয়র কমান্ডার।
সোলেমানির হত্যা নিয়ে রোববার বরিস বলেন, সোলেমানির জন্য শোকাহত নই। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের সব স্বার্থের জন্য হুমকি ছিলেন সোলেমানি। কাজেই তিনি নিহত হওয়ায় আমরা শোক করবো না। সেই সঙ্গে তেহরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, সোলেমানি হত্যার প্রতিশোধ নিতে হামলা করলে সহিংসতা আরও বাড়বে। তাতে কারো লাভ হবে না। বরিসের এই মন্তব্যের জবাবে ইরানের কমান্ডার বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেন ও মার্কিন সেনাসহ তাদের মিত্র দেশগুলোর সেনাদের ওপর হামলা চালাতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করবে না ইরানি সেনারা।’
‘কফিনে ভরে দেশে পাঠানো হবে মার্কিন সেনা-কর্মকর্তাদের’: সোলেমানি ও তার সহযোগী ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠী হাশদ আল-শাবির কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিস হত্যাকা-ের প্রতিশোধ নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর মহাসচিব হাসান নাসরাল্লাহ।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, মার্কিন সেনা ও কর্মকর্তাদের কফিনবন্দি করে দেশে পাঠানো হবে। রোববার রাতে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘যখন আমেরিকান সেনা ও কর্মকর্তাদের কফিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে শুরু করবে, তখন ট্রাম্প ও তার প্রশাসন বুঝবে যে তারা সত্যিই এ অঞ্চলে হেরে গেছে। তারা আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও হারবে।’ শিয়াপন্থী রাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে লেবাননের হিজবুল্লাহরও সখ্য রয়েছে। নেতৃস্থানীয় ভূমিকার কারণেই সোলেমানির সঙ্গে দারুণ সখ্য শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরাল্লাহর।
সোলেমানি ও মুহান্দিস ‘শাহাদত’ বরণের মধ্য দিয়ে নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, জেনারেল সোলেমানি হত্যাকা-ের জবাব দেয়া কেবল ইরানের দায়িত্ব নয়। এটা গোটা প্রতিরোধ শক্তির দায়িত্ব। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি, নৌজাহাজ, সামরিক কর্মকর্তাদের তালিকা ধরে ধরে সশস্ত্র বাহিনীর ওপর হামলা করাই তাদের উপযুক্ত শান্তি হবে।
মধ্যপ্রাচ্য উত্তেজনা হ্রাসে একাট্টা ইউরোপ: সোলেমানিকে হত্যার জেরে মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা হ্রাসে একাট্টা প্রকাশ করেছে ইউরোপের বৃহত্তম তিন দেশ যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্স। মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে সোমবার ফোনে একে অপরের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।
মার্কেলের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা হ্রাসে একমত হয়েছেন চ্যান্সেলর, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এদিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে মধ্যপ্রাচ্যের এ যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সোলেমানি হত্যার পর সোমবার প্রথমবারের মতো মন্তব্য করেন আবে। বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। এ সংঘাতে জড়িত দেশগুলোকে কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বনের আহ্বান জানাচ্ছি।’