সূর্য না ডোবার দেশে রোজা রাখা

সুইডেনের সবচেয়ে উত্তরের শহর কিরুনায় গ্রীষ্মকালে প্রায় দেড় মাসসূর্যাস্তই হয় না

মাথাভাঙ্গা মনিটর: সুইডেনের সবচেয়ে উত্তরের শহর কিরুনায় গ্রীষ্মকালে প্রায় দেড় মাসসূর্যাস্তই হয় না। এবারের রমজানের প্রায় অর্ধেকটাই পড়েছে এই সময়ে। আরআর্কটিক সার্কেল বা উত্তর মেরু বলয়ের ভেতরে অবস্থিত এই শহরে এখন প্রায় ৭০০মুসলিম বসবাস করছেন। তাদের অনেকেই রোজা রাখেন। কিন্তু যেখানে সূর্য ডোবেনা, সেখানে কখন সেহরি খাবেন আর কখনই বা ইফতার করবেন তারা?আল জাজিরা ডটকমএক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সূর্য না ডোবার দেশে রোজা রাখার অভিজ্ঞতার কথা।

উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের অনেকটা অংশজুড়েই গ্রীষ্মকালের একটানির্দিষ্ট সময় আক্ষরিক অর্থেই সূর্য ডুবতে দেখা যায় না। তেমনি শীতকালেরওএকটা নির্দিষ্ট সময় ধরে সূর্য উঠতে দেখা যায় না। গ্রীষ্মকালের এ সময়টাকে ‘মেরু দিন’ এবং শীতকালের এই সময়টাকে ‘মেরু রাত্রি’ বলা হয়ে থাকে।স্ক্যান্ডেনেভিয়া অঞ্চলের দেশ সুইডেনের কিরুনা শহরটি আর্কটিক সার্কেল বাউত্তর মেরু বলয়ের আরও ১৪৫ কিলোমিটার ভেতরে। এখানে গ্রীষ্মকালেও পর্বতচূড়াগুলো শাদা বরফে ঢাকা থাকে। পুরো গ্রীষ্মকালেই রাতের আকাশ থাকে অনেকটাইআলোকিত, পুরো শীতকালে দিনের আলোর দেখা মেলা ভার।

মাত্র ১০০ বছরের কিছু আগে বসতি স্থাপনের মধ্যদিয়ে কিরুনা শহরের পত্তনহয়েছিলো মূলত লোহার খনিকে ঘিরে। খনির শহর কিরুনায় সব মিলিয়ে হাজার বিশেকবাসিন্দার মধ্যে একটা বড় অংশই অভিবাসী শ্রমিক। এদের মধ্যে আছেন বিভিন্নদেশ থেকে সুইডেনে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী মুসলিমরাও। গত কয়েক দশকেএখানে আসা মুসলিমরা ভৌগোলিক কারণে নামাজের সময়সূচি এবং রোজা রাখা নিয়েবিপাকে পড়েন। এ বিষয়ে মুসলিম ধর্ম-তাত্ত্বিকদের নির্ধারণ করা কোনোসুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় কিরুনার মাত্র কয়েক’শ মুসলিমও ভিন্ন ভিন্ন নিয়মমেনে চলেন।

সিরিয়া থেকে আসা গাশান আলানকার জানান, ‘রাত সাড়ে ৩টার দিকে সেহরি করেআমি যখন রোজা শুরু করি, তখনো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকেমধ্যরাতের সূর্য। আমার ঘরে দু পরত করে পর্দা লাগানো থাকলেও বাইরে থেকে আসাআলোর মধ্যেই আমাকে ঘুমাতে যেতে হয়।’ আলানকার সৌদি আরবের মক্কা নগরের সময়ের সঙ্গে মিল রেখে রোজা রাখেন। তবে, তার ইবাদত কবুল হয় কি না, তা নিয়ে সংশয়ও আছে আলানকারের। সিরিয়ায় যুদ্ধেরকবল থেকে পালিয়ে মাত্র সাত মাস আগে লেবানন হয়ে তুরস্ক ও গ্রিস ঘুরে কিরুনায়আসেন তিনি। মক্কার সময়ের সঙ্গে মিল রেখে রোজা রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওইটাই ইসলামের জন্মভূমি। আমি ভুল করছি কি না, জানি না। কিন্তু আল্লাহরঘরকে ঘিরে আমার ইবাদত তো কবুল হওয়ার কথা।’

অবশ্য, কিরুনা শহরের বেশির ভাগ মুসলিমই এক হাজার ২৪০ কিলোমিটার দূরেসুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের স্থানীয় সময়ের সঙ্গে মিল রেখে সেহরি ও ইফতারকরেন। ডাবলিনভিত্তিক মুসলিম শরিয়া আইন বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ইউরোপিয়ানকাউন্সিল অব ফতোয়া অ্যান্ড রিসার্চ (ইসিএফআর) সম্প্রতি তাদের এ পরামর্শদিয়েছে। এখানকার এতো দীর্ঘদিনে রোজার অভিজ্ঞতা সশরীরে দেখে এ বিষয়ে পরামর্শদেয়ার জন্য সংগঠনটির মহাসচিব হুসেইন হালাওয়াকে এ রমজানে দাওয়াত দিয়েনিয়ে আসেন কিরুনার মুসলিমরা। স্টকহোমের সময় অনুসরণ করা সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা নিকটবর্তী শহর, যেখানে ‘রাত আর দিন আছে।’

ইরিত্রিয়া থেকে আসা মুসলিম ইদ্রিস আবদুল ওয়াহাব ইসিএফআরের ফতোয়া অনুসরণকরে স্টকহোমের সময় মেনে রোজা রাখেন। সেই হিসেবে রমজানে তার দীর্ঘতম রোজাটিহবে ২০ ঘণ্টার।কিরুনায় আরেক দল মুসলিম আছেন, যারা নামাজের স্থানীয় নির্ধারিত সময়েরসাথে মিল রেখেই রোজা রাখেন। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে আসা কানিজফাতিমা তাদের অন্যতম। এ সময়সূচি অনুসারে সেহরি ও ইফতার করলে ফাতেমাররোজার দিনগুলো গড়ে ১৮ ঘণ্টার মতো হবে। তবে, সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনেরকারণে তাকে সর্বোচ্চ ২৩ ঘণ্টাও রোজা রাখতে হবে। নিজের মতামত তুলে ধরেফাতিমা বলেন, ‘আমি কিরুনায় থাকি। সারা বছর আমি এখানকার নির্ধারিত সময়েনামাজ পড়ি। তাহলে রমজানের সময় আমি কেন স্টকহোমের সময় মেনে রোজা রাখবো?’ বেলুচিস্তান থেকে কিরুনায় আসার পর থেকে গত চার বছরই ফাতিমা এই নিয়ম মেনেচলছেন।

সোমালিয়া থেকে আবদুল নাসের মোহাম্মদ ২০০০ সালে কিরুনায় আসেন। সেবারএখানে রমজান পড়েছিলো শীতকালের মাঝামাঝি। তিনি বলেন, ‘কোথাও প্রতিষ্ঠিত কোনোইসলামি সংগঠন এ বিষয়ে স্পষ্ট মতামত দেয়নি এবং আমি ইন্টারনেটে খুঁজেও কিছুপাইনি। তাই আমাকে আমার মতোই আইন বানিয়ে নিতে হয়েছিলো। আমি সে সময় প্রতিদিনপাঁচ ঘণ্টার মতো রোজা রেখেছি।’

আবদুল নাসের এখন কিরুনার ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। তিনি এখনগ্রীষ্মকালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সময়সূচি মেনে সেহরি ও ইফতার করেন। কেননাতুরস্কই সুইডেন থেকে সবচেয়ে কাছের মুসলিমপ্রধান দেশ। তবে, বিষয়টা ব্যাখ্যাকরে তিনি বলেন, ‘ইসলাম কঠোর নয়। আর রোজাও মানেও খালি উপোস থাকা বা নিজেকেকষ্ট দেয়া নয়। ফলে, মানুষের নিজের সুবিধামতো বেছে নেয়ার অধিকার আছে।’

বিশ্বব্যাপি মুসলিমদের অনুসরণ করা হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে মাস বা তারিখশুরু হয় চাঁদ দেখা যাওয়ার মধ্যদিয়ে সন্ধ্যায়। আর প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্তনামাজের সময় নির্ধারণ হয়ে থাকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত মেনে চলে সূর্যেরঅবস্থানের সাপেক্ষে। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সাথে হিসাব মেলালে দেখা যায়, চাঁদের পরিক্রমা অনুসারে প্রতিবছরই ১১ দিন করে এগিয়ে আসে রমজান মাস। আর এহিসাবে প্রতি ৩৩ বছরে একবার ঘুরেফিরে ঠিক একই সময়ে রমজান পালনের সুযোগ পানমুসলিমরা।

কিরুনায় এবারের রমজান গ্রীষ্মকালে হলেও একসময় তা শীতকালে চলে যাবে। আরএখন সূর্য না ডোবার সমস্যার পরিবর্তে তখন সূর্য না ওঠার সমস্যায় পড়বেনএখানে বসবাসকারী মুসলিমরা। গ্রীষ্মকালে দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখার পরিবর্তেতখন মাত্র কয়েক ঘণ্টা রোজা রাখতে হবে তাদের। কিন্তু শীতকালের কিছুদিন পাঁচওয়াক্ত নামাজও পড়তে হবে মাত্র দু ঘণ্টার মধ্যেই। কেননা বছরের ওই সময়েমাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্যই আকাশে সূর্য দেখা যাবে। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিআকর্ষণ করা হলে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফতোয়া অ্যান্ড রিসার্চের মহাসচিবহুসেইন হালাওয়া আল জাজিরাকে জানান, কিরুনার মতো এমন প্রতিকূল ভৌগোলিকঅঞ্চলে নামাজ ও রোজার সময়সূচি নির্ধারণ করা নিয়ে এই বছরের শেষ দিকে তারাএকটা সম্মেলন আয়োজনের চেষ্টা করছেন।