সীমান্তে মিয়ানমারের ভারী অস্ত্রসহ সৈন্য সমাবেশ : ফাঁকা গুলি

সতর্কাবস্থায় বিজিবি : পতাকা বৈঠক প্রত্যাখ্যান বিজিপির : সীমান্ত লঙ্ঘন করলে কড়া জবাব : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার: সীমান্তের শূন্যরেখায় ক্যাম্প করে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সরে যেতে ভয়-ভীতি দেখানো মিয়ানমার সৈন্যরা ফাঁকাগুলি ছুড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তের ওপারে অবস্থানরত মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ সদস্যরা দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

বি‌জি‌বি ও স্থানীয়রা জানায়, বান্দরবান জেলার ঘুমধুম ইউনিয়য়নের তুমব্রু কোনাপাড়া সীমা‌ন্তে গু‌লি ছুড়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বা‌হিনী। সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া রো‌হিঙ্গাদের ভয়ভী‌তি দেখাতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বা‌হিনী বি‌জি‌পি কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গু‌লি ছোড়ে। এ ঘটনায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে রো‌হিঙ্গাসহ সীমান্ত অঞ্চলের বা‌সিন্দাদের মধ্যে। তবে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বি‌জি‌বি। গু‌লিবর্ষ‌ণের বিষয়‌টি নি‌শ্চিত করেছে বি‌জি‌বি।

জানা গেছে, শূন্যরেখা থেকে প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণার মধ্যেই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের ওপারে অতিরিক্ত সেনা ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করেছে মিয়ানমার। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র দেড়শ’ ফুট দূরে মিয়ানমারের এই তত্পরতায় সর্বোচ্চ সর্তক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

শূন্যরেখায় অবস্থান করা রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার নির্দেশনা দিয়ে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি মাইকিং করছে। এ অবস্থায় ভয়ে ও আতংকে ওই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। বিজিবি পতাকা বৈঠকের আহবান জানালেও তাতে সাড়া দেয়নি বিজিপি।

এদিকে, সীমান্তে বিজিবিকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্ত লঙ্ঘন করলে কিংবা কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করলে বিজিবি তার সমুচিত জবাব দেবে। অন্যদিকে সীমান্তে উত্তেজনার ব্যাপারে জানতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উ’কে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অপারেশন্স অ্যান্ড ট্রেনিং) মুজিবুর রহমান বলেন, তমব্রু সীমান্তের জিরো লাইন এলাকায় কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। এলাকাটি মিয়ানমার অংশে। কিছুদিন ধরে বিজিপি ও সেনাবাহিনী তমব্রু সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া, সেগুলো আরো মজবুত করা, উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সার্ভেলেন্স ইকুয়েপমেন্ট স্থাপন করার কাজ করছে। মাইকিং করে সেখানকার রোহিঙ্গাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য তারা বারবার বলছে, যা গত একমাস ধরে চলছে।

মিয়ানমার কোন কারণে ও কী পরিমাণ সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে এমন প্রশ্নে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, সৈন্যদের সঠিক সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। তবে সীমান্তে যে পরিমাণ সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। আর সেজন্য আমরা সতর্ক অবস্থানে থেকে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছি। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা মূলত রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে পাঠাতে এমনটি করছে।

তিনি বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা নাগাদ তমব্রু বর্ডার পোস্টের ৩৪ ও ৩৫ পিলারের মাঝামাঝি এলাকায় মিয়ানমার অংশের প্রায় ১৫০ গজ ভেতরে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে। বেশ কিছু মিলিটারি প্যাটার্নের পিকআপ, ট্রাক-লরির মাধ্যমে তারা সেখানে ভারী অস্ত্র স্থাপন করেছে। আমরা সার্ভেলেন্স ও ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে এসব তথ্য জানতে পেরেছি। এরপর থেকে আমরাও সতর্ক অবস্থানে রয়েছি, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। তাদের ইতোমধ্যে পতাকা বৈঠকের আহ্বান করেছি। প্রতিবাদলিপিও পাঠিয়েছি। কিন্তু কোন সাড়া মিলেনি।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, সীমান্তের নিরাপত্তায় বিজিবি সর্বদা সতর্ক অবস্থায় পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্ত লঙ্ঘন করলে কিংবা কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করলে বিজিবি তার সমুচিত জবাব দেবে। বিজিবির সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে আছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার কেন সমরাস্ত্র প্রদর্শন করছে তা জানার চেষ্টা করেছি। মিয়ানমার মুখে যা বলে তা বাস্তবায়ন করে কম। তারপরও বিজিবি মহাপরিচালক মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ করেছে। সীমান্তে বিজিবি অত্যন্ত সতর্ক রয়েছে। সীমান্ত দিয়ে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব: গতকাল বিকেলে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উ’কে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব এম খোরশেদ আলম তাকে তলব করেন। এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক পত্র (নোট ভারবাল) তাকে দেওয়া হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, সীমান্ত্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় এবং বলা হয়, এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য ভালো নয়। তাকে একটি নোট ভারবাল বা আনুষ্ঠানিক পত্র দেয়া হয়। এতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে আলোচনা হয় এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ না করার জন্য আহবান জানানো হয়। অন্য একটি সূত্র জানায়, রাখাইনে সামরিক শক্তি বাড়ালে নো-ম্যানস ল্যান্ডে যে ছয় হাজার রোহিঙ্গা আছে তারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে আগ্রহী হবে না এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে।

উলে­খ্য, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন অঙ্গরাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনী অব্যাহত নিপীড়ন ও গণহত্যা চালানো শুরু করলে দেশটি থেকে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে।