সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও সেনা মোতায়েনে না

ইসির সাথে সংলাপে প্রস্তাব আওয়ামী লীগের

স্টাফ রিপোর্টার: আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের মতো ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ, ২০১৪ সালের সংসদীয় আসনের সীমানা অক্ষুণ্ণ রাখা, সেনাবাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মতো মোতায়েন না করা, তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাইসহ ১১ দফা প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনে অনুষ্ঠিত সংলাপে অংশ নিয়ে দলটি এই প্রস্তাব দেয়। এছাড়া লিখিত প্রস্তাবের বাইরে সিইসিকে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচনকে ঘিরে ভোটের আগে যেসব অপপ্রচার হয়তো রোধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

জানা গেছে, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ৯ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন। ইসির কাছে উত্থাপিত আওয়ামী লীগের লিখিত প্রস্তাবের ‘গণতন্ত্র ও নির্বাচন: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক সূচনা বক্তব্যে বলা হয়, ‘জিয়াউর রহমান সংবিধান ও সব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ধ্বংস করেছেন।’ এতে আরও বলা হয়, স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত অপশক্তি ও তাদের এদেশীয় দোসররা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ রাতের আঁধারে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্তব্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা।

লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের বিশদ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ‘১৯৮১-৯১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যে সংগ্রাম করে আসছিলেন স্বৈরশাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে তার প্রাথমিক বিজয় হয়। জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে।’

সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ তার ব্যাখ্যা পেয়েছে। তবে ব্যাখ্যার বিষয়ে কিছুই বলতে চাই না। আর কোনো ব্যাখ্যা দিতে হলে সেটা ইসি দেবে।’ এ সময় সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার ও সচিবের বক্তব্য ইতিবাচক ছিলো বলে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে যে ১১ দফা প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনে তুলে ধরেন সে বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনা, নির্বাচনের তিন মাস আগে পোলিং এজেন্টদের পরিচয় রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

ওবায়দুল কাদের বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব হলো- তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত নির্বাচন পরবর্তী সময়ের জন্য প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ন্যস্ত থাকবে। সেনা মোতায়েন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ বলেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করা যাবে, তা ১৮৯৮ সালে প্রণীত ফৌজদারী কার্যবিধির ১২৯-১৩১ ধারায় এবং সেনা বিধিমালায় ইনএইড টু সিভিল পাওয়ার শিরোনামে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এক্ষেত্রে আরো বলা হয়, বর্তমানে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আনসারসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জনবল ও সক্ষমতা পূর্ববর্তী যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বাহিনীকে সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তাদের বিশেষায়িত অবস্থান বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সীমানা পুনর্নির্ধারণ না করার যুক্তি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ বলেছে, সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি জনসংখ্যার বিশেষ করে আদমশুমারির সাথে সম্পর্কিত। সর্বশেষ ২০১১ সালে আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে (যা ২০১৩ সালে প্রকাশিত) ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন আদমশুমারি ব্যতীত পুনরায় এই সীমানা পুনর্নির্ধারণের কার্যক্রম গ্রহণে বিভিন্ন আইনগত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।

ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত বিষয় নিয়ে ইসিকে সতর্ক হয়ে কথা বলার পরামর্শ: একটি সূত্র জানায়, জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা না চেয়ে আওয়ামী লীগের একজন নেতা ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত বিষয় নিয়ে ইসিকে সতর্ক হয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি এসব বিষয়ে নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি না করার কথাও বলেন। জানা গেছে, সিইসির এ ধরনের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যার অবকাশ থাকায় সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে ইসির পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে সব দলের সাথে আলোচনার সময়ই দলটির প্রতিষ্ঠা এবং প্রোফাইল তুলে ধরা হয়। বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সময় দলের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার সময় এ বিষয়ে অবতারণা করা হয়েছে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের প্রধান ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও এইচ টি ইমামসহ কয়েকজন নেতা সিইসিকে সতর্ক হওয়ার বিষয়ে কথা বলেন। তারা বলেন, ইতিহাসের স্যাটেলড বিষয় নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি না করাই মঙ্গল।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের ২১ সদস্যের প্রতিনিধি দল এতে অংশ নেয়। বেলা ১১টা থেকে ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত এই সংলাপ চলে। দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, এইচ টি ইমাম, ড. মসিউর রহমান, প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, দফতর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন, মোহাম্মদ জমির, মো. রশিদুল আলম প্রমুখ। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দিন আহমেদ সংলাপে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।

গণভবনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ: এদিকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের সার্বিক বিষয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে। ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলটি গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংলাপের সার্বিক বিষয় অবহিত করেন।