সার্চ কমিটি ঘিরেই আবর্তিত রাজনীতি

১২ বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে মতবিনিময় : আরও পাঁচজন আমন্ত্রিত

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন-সংক্রান্ত সার্চ কমিটি নিয়েই এখন আবর্তিত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। সার্চ কমিটি তাদের কাজ শেষ করার জন্য ১০ কার্যদিবস হাতে রেখেই নিজেদের কর্মপন্থা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সার্চ কমিটি দেশের ৩১ রাজনৈতিক দলের কাছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের জন্য নাম চেয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকালের মধ্যে সেসব নাম জমা পড়বে বলে সার্চ কমিটি আশা করছে। সার্চ কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা যা করার ৮ ফেব্রুয়ারি মাথায় রেখেই করবেন। ৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং একজন ছাড়া বাকি কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।

সার্চ কমিটির ওই সদস্য জানান, রাজনৈতিক দল এবং বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে নামের প্রস্তাব পাওয়ার পরই তারা দ্রুত নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে চান। মঙ্গলবারের মধ্যেই সার্চ কমিটি তাদের কাজ শেষ করতে চায় বলে কমিটি সূত্রে জানা গেছে। সার্চ কমিটির একজন সদস্য জানান, রাজনৈতিক দল, বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে নামের প্রস্তাব ছাড়াও কেউ যদি নিজেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্য মনে করেন তাহলে তিনিও নিজের নাম প্রস্তাব করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আগ্রহী ব্যক্তিকে তার জীবনবৃত্তান্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে জমা দিতে হবে। সার্চ কমিটির ওই সদস্য জানান, এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে বলা হয়েছে কেউ তার নিজের নাম প্রস্তাব করলে যেন আগ্রহী ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত জমা রাখা হয়। এমন আগ্রহী কেউ কেউ সার্চ কমিটির কোনো কোনো সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে। সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশার হিসেবে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে। সেখানে থেকে রাষ্ট্রপতি পরবর্তী নির্বাচন কমিশন ঠিক করবেন। যদিও রাষ্ট্রপতি চাইলে সে সব নাম থেকে কোনো নাম গ্রহণ না করার এখতিয়ার রাখেন।

জানা গেছে, সার্চ কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সাবেক আমলাদের তুলনামূলক অগ্রাধিকারের বিষয়টি ভাবছে এবং চিন্তায় রেখেছে। কমিটির সদস্যদের মতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার যিনি হবেন তার আইন সম্পর্কে অতীত অভিজ্ঞতা এবং ভালো ধারণা থকলে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করা সুবিধা হয়। তাছাড়া সাবেক আমলাদের পক্ষেও কমিশন পরিচালনায় ভূমিকা রাখা সুবিধাজনক। সার্চ কমিটি গঠনের পর থেকে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল এ বিষটি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশায় সাবধানী পা ফেলছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নিজেদের দলীয় সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরামসহ নিজস্ব ফোরামে একাধিক সভা করছেন গত দুদিন। ইতোমধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালদা জিয়া দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সভা করেছেন। ২০-দলীয় জোট নেতারাও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সভা করছেন। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, তারা সার্চ কমিটিতে নাম দেয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। এটি দলের চেয়ারপারসনের নেয়া ইনিশিয়েটিভ। এরইমধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও সার্চ কমিটিতে নাম প্রস্তাব প্রসঙ্গে তৎপর। সিনিয়র নেতা পর্যায়ে পৃথক আলোচনার পাশাপাশি দলের শীর্ষ নেতারাও এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে কোনো একগুঁয়েমি করেনি। সার্চ কমিটি গঠন ছাড়াও নির্বাচন কমিশন করা যেতো। কিন্তু সরকার তা করেনি।’

বিশিষ্টজনদের মত জানলেন সার্চ কমিটির সদস্যরা: এদিকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মতামত শুনেছেন রাষ্ট্রপতির গঠিত সার্চ কমিটির সদস্যরা। সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে সোমবার বিকাল ৪টা থেকে ২ ঘণ্টা তাদের এই বৈঠক চলে। আমন্ত্রণ পাওয়া ১২ বিশিষ্টজনের সবাই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাবি্বর ফয়েজ জানান। আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে সার্চ কমিটির সদস্যরা বিকাল পৌনে ৪টার দিকে জাজেস লাউঞ্জে পৌঁছান। আর বৈঠকের আমন্ত্রণ পাওয়া ১২ বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুর রশিদ সবার আগে বৈঠকস্থলে আসেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এসএমএ ফায়েজ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আইনজীবী সুলতানা কামাল, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন, এম সাখাওয়াত হোসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষক তোফায়েল আহমদ, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বদিউল আলম মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা উপস্থিত হন। শনিবার এই জাজেস লাউঞ্জেই সার্চ কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। সেখানেই বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনার সময় ও তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়া ৩১টি রাজনৈতিক দলের কাছে নির্বাচন কমিশনের জন্য পাঁচটি করে নামের প্রস্তাব চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে। মঙ্গলবার বেলা ১১টার মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন ও বিধি) কাছে এই নাম জমা দিতে বলা হয়েছে দলগুলোকে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত বুধবার এই সার্চ কমিটি গঠন করে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য নাম প্রস্তাবের দায়িত্ব দেন। তাদের সুপারিশ থেকেই অনধিক পাঁচ সদস্যের ইসি নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, মহা হিসাব নিরীক্ষক (সিএজি) মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরীন আখতার। এই কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দিচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছেন, নির্ধারিত ১০ কার্যদিবস, অর্থাৎ ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সার্চ কমিটির সব কার্যক্রম শেষ করে ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন কমিশন পাওয়া যাবে বলে তারা আশা করছেন।

আরও পাঁচজনকে আমন্ত্রণ: এদিকে নতুন নির্বাচন কমিশনর (ইসি) গঠনে রাষ্ট্রপতি গঠিত সার্চ কমিটি দেশের আরও পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিককের সঙ্গে বসবে। ওই পাঁচ জন হলেন- সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ। কাল বুধবার ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে এই পাঁচজনের সাথে এ মতবিনিময় হবে।

সার্চ কমিটিতে নাম দেয়ার সময় বাড়লো: নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর নাম জমা দেয়ার সময় বেড়েছে ৪ ঘণ্টা। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ইসি গঠন নিয়ে সংলাপে অংশ নেয়া ৩১টি রাজনৈতিক দল মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত পাঁচজন করে নাম প্রস্তাব করতে পারবে।  এর আগে মঙ্গলবার বেলা ১১টার মধ্যে এই নাম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন ও বিধি) কাছে জমা দিতে চিঠি পাঠানো হয়েছিল দলগুলোকে। সোমবার বিকালে ?সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে ১২ বিশিষ্ট ব?্যক্তির সঙ্গে সার্চ কমিটির সদস্যদেও বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সময় বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘নাম জমা দেয়ার সময় ৪ ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নাম জমা দিতে পারবে।’ দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া নাম যাচাই-বাছাই করে রাষ্ট্রপতির গঠিত ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি ৮ ফেবব্রুয়ারির মধ্যে তাদের সুপারিশ জমা দেবে। তাদের সুপারিশ থেকেই অনধিক পাঁচ সদস্যের ইসি নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।